বয়স তখন কত? বছর দশেক হবে। বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে উত্তরপ্রদেশের গ্রাম থেকে মুম্বইয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা। থাকার জায়গা? কিছুই ঠিক ছিল না। আজাদ ময়দানে মালিদের তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে সে। তিন বছরেরও বেশি। ক্যান্টিনে খাওয়া। কিছু অর্থ উপার্জনের আশায় পানিপুরি (ফুচকা), পাওভাজি বিক্রি করেছে মুম্বইয়ের রাস্তায়। কিন্তু শত কষ্টেও ক্রিকেটকে ফাঁকি দেয়নি সেই ছেলে। সেই পরিশ্রম, সেই নিষ্ঠা, সেই জেদের ফল মিলছে একটু একটু করে।
আইপিএল মাতিয়েছেন। প্রাক্তনরা তাঁর ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের জাত চিনিয়েছেন। ইরানি কাপে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে অবশিষ্ট ভারতের হয়ে যশস্বী করেছিলেন ২১৩ এবং ১৪৪ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তরুণ এই ব্যাটারের গড় ৮০.২১। সামগ্রিক পারফরমেন্সের নিরিখেই যশস্বী জয়সওয়াল এবার ঢুকে পড়লেন জাতীয় দলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের টেস্ট দলে জায়গা হয়েছে এই বাঁহাতি ব্যাটারের। একই দিনে বাদ পড়েছেন চেতেশ্বর পুজারার মতো তারকা। বোর্ডের অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, ‘ভবিষ্যতের’ কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত। টেস্টে পুজারার ছেড়ে যাওয়া তিন নম্বরে নাকি ভাবা হচ্ছে যশস্বীকেই।
ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতীয় দলে স্ট্যান্ডবাই ছিলেন যশস্বী। তারপর কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। ২৩ জুন, শুক্রবার সকালে প্র্যাকটিস ছিল। দুপুরে বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের মধ্যে যখন খবরটা পেয়েছিলেন, মিশ্র অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল যশস্বীকে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন রূপ পেয়েছে বাস্তবে। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উত্তেজনার পাশাপাশি কিছুটা নার্ভাসও। ছেলের থেকে খবরটা পেয়ে আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি যশস্বীর বাবা।
কী বলছেন যশস্বী? ‘দারুণ অনুভূতি। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে। এমন খবর পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত। কিন্তু চাইব স্বাভাবিক থেকেই নিজেকে মেলে ধরতে। স্কোয়াড ঘোষণা হওয়ার পর তালিকায় নিজের নাম দেখে একটু নার্ভাসও হয়ে পড়েছিলাম। পেট গুড়গুড় করছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে অবশ্যই ভাল অনুভূতি। প্রস্তুতি ভাল চলছে। অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেছি (নিজেই জানিয়েছেন কথা হয়েছে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, অজিঙ্কা রাহানের সঙ্গে)। ওদের থেকে শিখছি। সবার একটাই পরামর্শ। ফোকাস ঠিক রাখা। সবটাই আমার হাতে। আমি কীভাবে এগোব, আমাকেই ঠিক করতে হবে। কত নম্বরে ব্যাট করব, তা নিয়ে আমার কোনও পছন্দ নেই। সবটাই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে শৃঙ্খলা বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
সান্তাক্রুজে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালাতেন জ্বালা সিং। ২০১৩–র ডিসেম্বরে আজাদ ময়দানে তাঁরই চোখে পড়ে যান যশস্বী। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৫–তেই যশস্বী চলে আসেন প্রচারের আলোয়। গাইলস শিল্ডের একটি ম্যাচে করেছিলেন অপরাজিত ৩১৯। শুধু তাই নয়, ম্যাচে ১৩ উইকেটও নিয়েছিলেন যশস্বী! সুযোগ পেয়ে যান মুম্বইয়ের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে। ২০১৮–য় অনূর্ধ্ব ১৯ এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। সর্বাধিক রান ছিল যশস্বীর (৩১৮), প্রতিযোগিতার সেরাও হয়েছিলেন তিনি। ২০২০ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ভারত পারেনি চ্যাম্পিয়ন হতে, কিন্তু সেবারও নজর কেড়েছিলেন যশস্বী। সর্বাধিক রান (৪০০) ছিল তাঁর, এবারও প্রতিযোগিতার সেরা। ১৭ বছর ২৯২ দিনের মাথায় লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের ইতিহাসে কনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরির নজির আছে যশস্বীরই। শেষ আইপিএলে তিনি ছিলেন অনবদ্য ছন্দে। রাজস্থান রয়্যালসের জার্সিতে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছেন, আইপিএলের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি (১৩ বলে) করেছেন কেকেআরের বিরুদ্ধে।
ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি যে বিশেষ প্রতিভা, তা বারবার প্রমাণ করেছেন যশস্বী। এবার অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে তাঁকে। নির্বাচকরা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। ভারতীয় টেস্ট দল নতুন সন্ধিক্ষণের দিকে এগোচ্ছে। ক্রমশ নতুন রক্তের প্রবেশ হচ্ছে। বিশ্বাস, যশস্বী হতাশ করবেন না।