মেলবোর্নের মহারণ: তিন দশক আগে

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে আগামী রবিবার (১৩ই নভেম্বর, ২০২২) পুরুষদের সীমিত-ওভারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ঘটতে চলেছে একটা ঘটনা – আই.সি.সি (ICC), অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল, আয়োজিত পুরুষদের টি২০ বিশ্বকাপ ২০২২ প্রতিযোগিতার ফাইনালে মুখোমুখি হতে চলেছে জস বাটলার-এর অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড এবং বাবর আজম-র নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান। ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রায় সকলেরই নজর থাকবে সেই ম্যাচটার দিকে – কোন দলের কেমন পরিকল্পনা হবে, কোন কোন খেলোয়াড় কেমন খেলবেন, কোন দল জিতবে, আগামী দু’বছরের জন্য বিশ্ব-জয়ী দলের মুকুট কাদের মাথায় ঠাঁই পাবে – এইসব নিয়ে তাঁদের আলাপ-প্রলাপ-বিলাপ, আলোচনা-মন্তব্য, বিচার-বিশ্লেষণ-ভবিষ্যদ্বা্ণী চলতেই থাকবে আগামী কয়েকদিন ধরে। এরই ফাঁকে আসুন একবার ফিরে তাকানো যাক প্রায় তিন দশক আগেকার সেই সময়টাতে যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার এমন ঘটনাটা ঘটেছিল।

সেটা ছিল ২৫ তারিখ – নাঃ জুন মাস নয়, ১৯৮৩ সালও নয় – সালটা ছিল ১৯৯২ আর মাসটা ছিল মার্চ। অকুস্থল লর্ডস ছিলনা, ছিল সেই এম.সি.জি (MCG), অর্থাৎ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। যুযুধান দুই পক্ষ – গ্রাহাম গুচ-এর অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড এবং ইমরান খান-এর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান, উপলক্ষ – বেনসন ও হেজেস বিশ্বকাপ ১৯৯২ প্রতিযোগিতার ফাইনাল। ঐ প্রতিযোগিতা নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাবনা, কারণ তাহলে বলতেই হবে আরও বেশ কিছু ‘প্রথমবার’ নিয়ে – (১) দিন-রাতের ক্রিকেটে সাদা-বল, রঙিন জার্সি ও কালো সাইট-স্ক্রিনের আবির্ভাব, (২) দক্ষিণ আফ্রিকা সমেত মোট ন’টি দলের অংশগ্রহণ, (৩) গ্রুপ-লিগ পর্যায়ে ‘রাউন্ড-রবিন’ ধরণের ম্যাচ, (৪) বহু-বিতর্কিত ‘রেইন রুল’-এর প্রয়োগ – এমন বেশ কিছু কথা, যার জন্য সেই বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সেসব বাদ দিয়ে বরং আমরা নজর দিই যুযুধান দুই ফাইনালিস্ট কেমনভাবে ফাইনালে উঠেছিল আর সেই ফাইনালটাই বা কেমন হয়েছিল, এমন ব্যাপারগুলোর দিকে। আসুন তবে, মাঠে নেমে পড়ি।

বৃষ্টি-ভেজা ইংল্যান্ড যেন আহত সিংহ

গত ১৯৮৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে অ্ল্পের জন্য অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত ইংল্যান্ড এবারের প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই বেশ দাপিয়ে খেলে প্রথম ছ’টা ম্যাচ থেকে ১১ পয়েন্ট তুলে নেয়,  হারিয়ে দেয় – ভারত (৯ রানে), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৬ উইকেটে), অস্ট্রেলিয়া (৮ উইকেটে), শ্রীলঙ্কা (১০৬ রানে), দক্ষিণ আফ্রিকা (৩ উইকেটে) এদেরকে। কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে জেতা ম্যাচ বৃষ্টির জন্য পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে বাধ্য হয়। টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে মাত্র ৭৪ রানে ৪০.২ ওভারে পাকিস্তানকে শেষ করে দিয়ে রান তাড়া করতে নেমে ইংল্যান্ড ৮ ওভারে ২৪/১ এই অবস্থায় বৃষ্টিতে ম্যাচ পন্ড হয়ে যায় – মাঝখানে একটা সময় ইংল্যান্ডের সংশোধিত লক্ষ্য (revised target) দাঁড়িয়েছিল ১৬ ওভারে ৬৪, কিন্তু তারা ন্যূনতম ১৫ ওভার ব্যাট না করতে পারায় প্রতিযোগিতার নিয়মানুযায়ী ম্যাচটা নিষ্ফল (no-result) ভাবে শেষ হয়। বৃষ্টি অবশ্য ইংল্যান্ডকে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচেও কিঞ্চিৎ ভুগিয়েছিল। টসে হেরে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে করে ২৩৬/৪ রান। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১২ ওভারে ৬২/০ অবস্থায় বৃষ্টি নামলে খেলা প্রায় ৪৫ মিনিট বন্ধ থাকে, সংশোধিত লক্ষ্য ৪১ ওভারে ২২৬ রান নিয়ে আবার খেলা শুরু হ’লে ৪০.৫ ওভারে ২২৬/৭ তুলে ইংল্যান্ড ম্যাচ জেতে।

সেমি-ফাইনালে যাওয়ার রাস্তা প্রায় পরিস্কার, এমন অবস্থায় ইংল্যান্ড কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে হেরে যায় – নিউজিল্যান্ড (৭ উইকেটে) ও জিম্বাবোয়ে (৯ রানে) এদের হাতে। লিগ পর্যায়ে পরপর ছ’টা ম্যাচ-জয়ী কিউয়িদের কাছে হারটা তেমন আশ্চর্যজনক না হ’লেও ‘লাস্ট বয়’ জিম্বাবোয়ের কাছে পরাজয়টা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল। যাহোক, মোট ১১ পয়েন্ট (নেট-রান-রেট ০.৪৭০) নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকে তারা সেমি-ফাইনালে যায়, মুখোমুখি হয় তৃতীয় স্থানাধিকারী – মোট ১০ পয়েন্ট (নেট-রান-রেট ০.১৩৮) – ‘নবাগত’ দক্ষিণ আফ্রিকার।

সিডনিতে বারবার বৃষ্টিবিঘ্নিত ঐ সেমি-ফাইনালে ঘটে সেই আজব ঘটনা। একটু খুলে বলি। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড নির্ধারিত ৪৫ ওভারে (বৃষ্টির জন্য ৫ ওভার বাদ গেছিল) ২৫২/৬ তোলে। রান তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৩১/৬, ১৩ বল বাকি থাকতে, এই অবস্থায় আবার বৃষ্টি বাদ সাধে। প্রায় ১৫ মিনিট পর আবার যখন খেলা শুরু হয়, তখন ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার হাতের বাইরে চলে গেছে। কারণ, সংশোধিত লক্ষ্য অনুযায়ী জিততে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে করতে হ’ত ১ বলে ২১ রান যা অসম্ভব। ব্যাটার ব্রায়ান ম্যাকমিলান সেই বলে একটা রান নিয়ে ইনিংস শেষ করেন। ফলে ইংল্যান্ড ১৯ রানে জিতে ফাইনালে যায়। এই ম্যাচকে কেন্দ্র ক’রে ‘রেইন রুল’ নিয়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় ওঠে এবং (রিচি বেনো সহ) নিয়ম-নির্ধারকরা প্রভূত সমালোচিত হন। মনে রাখতে হবে যে সংশোধিত লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য ডি.এল.এস (DLS), অর্থাৎ ডাকওয়ার্থ-লিউয়িস-স্টার্ন, পদ্ধতি আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেটে  চালু হয় আরও প্রায় বছর পাঁচেক বাদে।

এই পর্যায় অবধি ইংল্যান্ড দলের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত প্রদর্শনের মধ্যে কয়েকটা জানাই: ব্যাটিংয়ে গ্রাহাম গুচ (৫১, ৬৫, ৫৮), রবিন স্মিথ (৯১), গ্রেম হিক (৫৪, ৫৬, ৮৩), ইয়ান বথাম (৫৫), নিল ফেয়ারব্রাদার (৬৩, ৭৫*), অ্যালেক স্টুয়ার্ট (৫৯, ৭৭), এবং বোলিংয়ে ডার্মট রীভ (৩-৩৮), ক্রিস লুইস (৩-৩০, ৪-৩০), ফিল ডিফ্রেইটাস (৩-৩৪), ডেরেক প্রিঙ্গল (৩-৮), ইয়ান বথাম (৪-৩১, ৩-২৩), রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ (৩-৩৫); ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন: ইয়ান বথাম (দু’বার), ক্রিস লুইস (দু’বার), অ্যালেক স্টুয়ার্ট, গ্রেম হিক – আটটা ক্ষেত্রের মধ্যে (পাকিস্তান ম্যাচে এই নির্বাচন হয়নি) ছ’টাতেই তাঁরা এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। অতএব সব মিলিয়ে দেখতে গেলে দল হিসেবে ইংল্যান্ড রীতিমত প্রাধান্য নিয়ে ধারাবাহিক ভাবেই খেলেছিল।

খোঁচা-খাওয়া পাকিস্তান যেন কোণঠাসা বাঘ

গত ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে লাহোরের ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত পাকিস্তান এবারের প্রতিযোগিতার গোড়া থেকেই হোঁচট খেতে শুরু করে। প্রথম পাঁচটা ম্যাচ থেকে তাদের প্রাপ্তি মাত্র ৩ পয়েন্ট, তার মধ্যে একটা পয়েন্ট আবার বৃষ্টির আশীর্বাদে ইংল্যান্ডের কাছে অবধারিত পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে, সে কথা তো আগেই লিখেছি – বাকি দুটো পয়েন্ট পায় জিম্বাবোয়েকে ৫৩ রানে হারিয়ে। পাকিস্তান হেরে যায় – ওয়েস্ট ইন্ডিজ (১০ উইকেটে), ভারত (৪৩ রানে), দক্ষিণ আফ্রিকা (২০ রানে) এদের কাছে। সব মিলিয়ে অবসর-ভেঙে-ফিরে-আসা গর্বিত অধিনায়ক ইমরান-এর দলের সেমি-ফাইনালে ওঠবার আশায় প্রায় জলাঞ্জলি!

এহেন অবস্থায় খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়াল পাকিস্তান – পরপর শেষ তিনটে ম্যাচে হারিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়া (৪৮ রানে), শ্রীলঙ্কা (৪ উইকেটে), নিউজিল্যান্ড (৭ উইকেটে) এদেরকে – শেষ করল মোট ৯ পয়েন্ট (নেট-রান-রেট ০.১৬৬) নিয়ে চতুর্থ স্থানে। মোট ৮ পয়েন্ট পাওয়া অস্ট্রেলিয়া (নেট-রান-রেট ০.২০১) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ (নেট-রান-রেট ০.০৭৬) এদের আশায় জল ঢেলে দেয় পাকিস্তান – ১৮ই মার্চে ক্রাইস্টচার্চে ঘরের মাঠে ‘ফার্স্ট বয়’ নিউজিল্যান্ডকে দাপটের সঙ্গে হারিয়ে দিয়ে। অবশ্য প্রথম সাতটা ম্যাচ পরপর জয়ের সুবাদে মোট ১৪ পয়েন্ট (নেট-রান-রেট ০.৫৯২) নিয়ে কিউয়িরা ততদিনে সেমি-ফাইনালে চলেই গেছে।

অকল্যান্ডে সেমি-ফাইনালে আবার কিউয়িদের মুখোমুখি উদ্দীপ্ত পাকিস্তান। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়ে নিউজিল্যান্ড করল ২৬২/৭ – তখনকার দিনে রীতিমত ‘বড়’ রান – উত্তরে ৩৫তম ওভারের শুরুতেই ১৪০/৪ হয়ে গিয়ে পাকিস্তান তখন কোণঠাসা। কিন্তু খেলা ঘুরিয়ে দেন সদ্য-বাইশ-ছোঁওয়া বড়সড় ও ভারি চেহারার নবাগত এক তরুণ, সঙ্গে ছিলেন বহু যুদ্ধের পোড়-খাওয়া এক বিশ্বস্ত লড়াকু সৈনিক। ইনজামাম-উল-হক ৬০ রান (৩৭ বল, ৬x১, ৪x৭) ও জাভেদ মিয়াঁদাদ ৫৭* রান (৬৯ বল, ৪x৪) মিলে সাড়ে-দশ ওভারে ৮৭ রান যোগ করে সাজঘরে বসে-থাকতে-বাধ্য-হওয়া আহত কিউয়ি-অধিনায়ক মার্টিন ক্রো-এর অসাধারণ ৯১ রানের (৮৩ বল, ৬x৩, ৪x৭) ইনিংসের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিলেন। এক ওভার বাকি থাকতেই ২৬৪/৬ তুলে উইকেট-রক্ষক মঈন খান-কে সঙ্গে নিয়ে হাসিমুখে সাজঘরে ফিরলেন মিয়াঁদাদ: “Miandad ran towards his team-mates with his arms aloft as they ran on to the ground to celebrate’. এই ম্যাচের শেষে কিথ মিলার লেখেন, “All of a sudden, the New Zealand bowling attack (which throughout the tournament had mastered the low, slow wickets on offer) were given their first look at Inzamam-ul-Haq as he tore the attack to shreds, smacking 60 off just 37 balls (unheard of in 1992), he left New Zealand hopes in tatters. … Pakistan had prevailed, snatching what appeared to be a victory from the jaws of defeat.” 

নিউজিল্যান্ডের ফিল্ডিংয়ের সময় মাঠে উদ্ভাবন-কৌশলী অভিজ্ঞ অধিনায়ক ক্রো-এর অনুপস্থিতি [ব্যাটিংয়ের সময় তিনি হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান ও রানার নিতে বাধ্য হন।] কিউয়িদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল, এই নিয়ে তাঁদের কয়েকটা ব্যক্তিগত মন্তব্য উল্লেখ করি, যেগুলোর মধ্যে শেষের মন্তব্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • কেন রাদারফোর্ড: “A lot’s been said about the tactics in the field, but I don’t go along with that. No one could have foreseen the impact Inzamam would have.
  • গ্যাভিন লার্সেন: “With him (Crowe) off the park, the second innings at Eden Park was just soul-destroying.
  • দীপক প্যাটেল: “I don’t think that Wrighty (acting captain John Wright) could have done anything better than what Martin Crowe would have done. The simple fact is that one particular player took the game away from us, that’s how simple it was, to be honest with you.” 
  • মার্টিন ক্রো: “I had that dilemma of whether to go out on the field and captain the side and probably rule myself out of the final appearance if we made it, or to rest up and think that we had enough, and I could kill two birds with one stone by not fielding. In other words, the team would win, and I would be fit for the final. With what unfolded, I had made a massive mistake in not taking the field despite a hamstring injury, because I was trying to be fit for the final as opposed to getting the team through to the final.

এই পর্যায় অবধি পাকিস্তান দলের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত প্রদর্শনের মধ্যে কয়েকটা জানাই: ব্যাটিংয়ে রামিজ রাজা (১০২*, ১১৯), জাভেদ মিয়াঁদাদ (৫৭*, ৮৯, ৫৭), আমির সোহেল (১১৪, ৬২, ৭৬), সেলিম মালিক (৫১), এবং বোলিংয়ে ওয়াসিম আক্রম (৩-২১, ৪-৩২), মুস্তাক আহমেদ (৩-৫৯, ৩-৪১), আকিব জাভেদ (৩-২১); ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন: আমির সোহেল (দু’বার), জাভেদ মিয়াঁদাদ, মুস্তাক আহমেদ – আটটা ক্ষেত্রের মধ্যে (ইংল্যান্ড ম্যাচে এই নির্বাচন হয়নি) চারটেতে তাঁরা এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তবে সব মিলিয়ে দেখতে গেলে দল হিসেবে পাকিস্তান প্রতিযোগিতার দ্বিতীয়ার্ধেই অনেক বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছিল।

ওস্তাদের মার শেষ রাতে

পাকিস্তানের সেই প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা আর ইংল্যান্ডের সেটা তৃতীয়বার, ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের পর। ইংল্যান্ড চাইছিল অ্যাডিলেড-এর ১লা মার্চের হাতের মুঠো থেকে ফস্কে-যাওয়া জয়টাকে এবার পেতে। আর পকিস্তান? বিগত চারটে ম্যচে পরপর চারটে জয় পেয়ে তারা উজ্জীবিত, যেন অন্য একটা দল। MCG-তে সেদিন নাকি ছিলেন ৮৭,১৮২ জন দর্শক। ইয়ান চ্যাপেলের উপস্থিতিতে টস হয়, ইমরান জিতে ব্যাটিং নেন। তাঁর পরণের টি-শার্টের ওপর একটা বাঘের ছবি ছাপা ছিল, হয়ত বা ‘Cornered Tigers’ ইঙ্গিত করতে!

ইংল্যান্ডের টাইট বোলিংয়ের ফলে নবম ওভারেই ২৪/২ হয়ে পাকিস্তান চাপে পড়ে – সোহেল ও রামিজ আউট, দু’জনেই প্রিঙ্গল-এর শিকার। রামিজ অবশ্য আগেই একবার লুইস-এর বলে গালিতে হিক-র হাতে ধরা পড়েও বেঁচে যান, আম্পায়ার স্টিভ বাকনার নো-বল ডাকায়। দলের দুই অভিজ্ঞতম খেলোয়াড়, (তিন নম্বরে নামা) ইমরান এবং মিয়াঁদাদ, হাল ধরেন, যদিও রান উঠতে থাকে বেশ ধীরগতিতে। ইমরান তাঁর ব্যক্তিগত ৯ রানের মাথায়, ডিফ্রেইটাস-এর বলে তেড়ে মারতে গিয়ে অন-সাইডে ক্যাচ তুললেও মিড-উইকেট থেকে ছুটে-আসা গুচ সেটা ধরতে পারেননি। ঐ জুটিতে শতরান ওঠে ৩৫তম ওভারে। তার পরের ওভারে মিয়াঁদাদ তাঁর ব্যক্তিগত অর্ধশতরানে পৌঁছন (৮৮ বল)। এর পরপরই ইমরান-ও তাঁর ব্যক্তিগত অর্ধশতরানে পৌঁছন (৯১ বল)। জুটি (৩১ ওভারে ১৩৯ রান) ভাঙেন ইলিংওয়ার্থ, তাঁকে রিভার্স-স্যুইপ করতে গিয়ে মিয়াঁদাদ (৫৮ রান, ৯৮ বল, ৪x৪) ফিরে যান বথাম-এর হাতে ক্যাচ তুলে। ইনজামাম এসেই ব্যাটের মাঝখান দিয়ে শট খেলতে শুরু করেন, বিশেষত বথাম-এর বলে। এরপর পাকিস্তান ১৯৭/৪ হয়ে যায় ৪৪তম ওভারে যখন বথাম-এর বলে তুলে মারতে গিয়ে লং-অনে ধরা পড়েন ইমরান (৭২ রান, ১১০ বল, ৬x১, ৪x৫), ইলিংওয়ার্থ-এর হাতে। অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়কের ধৈর্যশীল দায়িত্ববান ব্যাটিংয়ে তৈরি এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ ছ’ওভারে পাকিস্তান পিটিয়ে যোগ করে ৫২ রান – ৪৬তম ওভারে বথাম দেন ১২ রান এবং ৪৯তম ওভারে লুইস দেন ১৭ রান, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাটার আক্রম। শেষ ওভারের পঞ্চম বলে প্রিঙ্গল ইনজামাম-কে (৪২ রান, ৩৫ বল, ৪x৪) বোল্ড করেন এবং আক্রম (৩৩ রান, ১৮ বল, ৪x৪) ইনিংসের শেষ বলে রান-আউট হয়ে যান। পাকিস্তান শেষ করে ২৪৯/৬ দিয়ে, যা সেই সময়ে লড়াকু বলেই গণ্য হ’ত। প্রিঙ্গল-ই ছিলেন সেরা বোলার (১০-২-২২-৩), বাকিরা সবাই অল্পবিস্তর মার খান। 

ইংল্যান্ডের ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই আক্রম ফেরান বথাম-কে – শূন্য রানে কট-বিহাইন্ড, যদিও বথাম খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন ঐ আউটের সিদ্ধান্তে এবং পরে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেন যে বলটা নাকি লেগেছিল তাঁর জামার হাতায়, গ্লাভসে নয়। অষ্টম ওভারে আকিব (জাভেদ)-এর বলে খোঁচা মেরে কট-বিহাইন্ড হন স্টুয়ার্ট – ২১/২ হয়ে গিয়ে ইংল্যান্ড তখন কাবু। সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন গুচ ও হিক। কিন্তু ১৯তম ওভারে হিক (লেগ-বিফোর) ও ২১তম ওভারে গুচ (আউট-ফিল্ডে কট) এই দু’জনকেই পরপর ফিরিয়ে দেন মুস্তাক (আমেদ)। গুচ মুস্তাক-কে এক্সট্রা-কভারের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে ক্যাচ তুললেও তা উইকেট-রক্ষক মঈন-এর নাগালের বাইরে যায়। কিন্তু তারপরেই আবার গুচ স্যুইপ করতে গিয়ে কানায় লাগিয়ে ডীপ-স্কোয়্যার-লেগ অঞ্চলে ক্যাচ তুললে আকিব দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে চমৎকার এক ক্যাচ ধরেন। ইংল্যান্ড, ৬৯/৪ হয়ে, তখন ধুঁকছে। দলকে ম্যাচে ফেরান ফেয়ারব্রাদার ও অ্যালান ল্যাম্ব, পঞ্চম উইকেটে ১৪ ওভারে ৭২ রান যোগ করে। জিততে গেলে ইংল্যান্ডের তখন বাকি ১০৯ রান, হাতে আছে ১৬টা ওভার ও ছ’টা উইকেট। এই অবস্থায় ৩৫তম ওভারে আক্রম-কে আক্রমণে নিয়ে আসেন ইমরান এবং ঐ ওভারের পঞ্চম ও শেষ বল দুটোতেই খেলার ফলাফল অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় – পরপর ফিরে যান ল্যাম্ব (৩১ রান, ৪১ বল, ৪x২) ও লুইস (‘গোল্ডেন ডাক’) – বাকি ১০৯ রান, হাতে আছে ১৫টা ওভার ও চারটে উইকেট। [এই প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে Wisden-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঐ ম্যাচের নির্বাচিত সেরা খেলোয়াড় আক্রম যা বলেছিলেন তার কিছু অংশ রচনার শেষে দিলাম – বোলারের উঁচুদরের দক্ষতা ও অধিনায়কের কৌশলী পরামর্শ এই দুইয়ের মেলবন্ধনের এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত।] এরপর ফেয়ারব্রাদার ও রীভ ৩৯ রান (প্রায় ৮ ওভারে) যোগ করলেও ততক্ষণে ইংল্যান্ড রান-রেট নিয়ে চাপে পড়ে গেছে – ৭০ রান বাকি, হাতে আছে ৭ ওভার মতন। এই অবস্থায় পরপর ফিরে যান দু’জনেই – ফেয়ারব্রাদার ৬২ রান (৭০ বল, ৪x৩)ও রীভ ১৫ রান (৩২ বল) – উইকেট দুটো নেন যথা্ক্রমে আকিব ও মুস্তাক। এরপর ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে ২২৭ রানের মাথায় শেষ ব্যাটার ইলিংওয়ার্থ-কে আউট ক’রে ইমরান নিজেই শেষ হাসিটা হাসলেন (১-৪৩) – মুস্তাক (৩-৪১), আক্রম (৩-৪৯), আকিব (২-২৭) ছিলেন বোলিং-শক্তির আধার। পাকিস্তান জিতল ২২ রানে, ১৭ বছরে পঞ্চমবারের প্রচেষ্টায় তাদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়! আর গুচ-এর এবং ইংল্যান্ডের তৃতীয়বার বিশ্বকাপ ফাইনালে হার!

শেষ কথা

১৯৯২ সালে MCG-র ফাইনালের আগে পরপর চারটে ম্যাচ (সেমি-ফাইনাল সমেত) জিতে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে ফাইনালের আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ড ছিল ধারাবাহিক ভাবে সফল, এমনকি পাকিস্তানকেও লিগ-ম্যাচে তারা প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল। মনে পড়ে কি ১৯৯৯ বিশ্বকাপের বিজয়ী স্টিভ ওয়-র অস্ট্রেলিয়া দলকে? অথবা ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ‘কালো ঘোড়া’ কপিল দেব-এর ভারতকে?

এই টি২০ বিশ্বকাপেও MCG-র ফাইনালের আগে পরপর চারটে ম্যাচ (সেমি-ফাইনাল সমেত) জিতে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে  দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান। অনদিকে ফাইনালের আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ড ধারাবাহিক ভাবে সফল। তাই কিছু কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যেন ১৯৯২ সালের ইতিহাসের টুকরো পাতা থেকে! 

তবে একটা কথা প্রচলিত আছে: “It is not how you start the race or where you are during the race – it is how you cross the finish-line that will matter.

ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হবেই আগামী রবিবার। কিন্তু সে কবেকার কোন ইতিহাস! বর্তমানের বাবর-এর দলের জন্য ১৯৯২ বা ২০০৯, নাকি জোশময় জস-এর দলের জন্য ২০১০ বা ২০১৯?? আমরা অপেক্ষায় আছি।

তথ্যসূত্র:    Wisden, Wikipedia, ESPN CricInfo এবং 

“Ruling the World” by Jonathan Northall from Pitch Publishing, UK, 2019 Edition

https://wisden.com/stories/archive/those-two-deliveries-were-totally-planned-wasim-akram-on-the-magic-of-9

 “Those two deliveries were totally planned. It was always the plan to come around the wicket to Allan Lamb and bowl outswing, because he never faced me in county cricket when it was reverse swinging, he usually batted No.3 or No.4. He must have thought, ‘Left-arm, round the wicket, going away? I don’t think so…’ It started on middle stump and went away from him against the angle. That ball was absolutely one of the top five balls I ever bowled. When Chris Lewis came out to bat, I was about to bowl a yorker. But Imran said he will be expecting a yorker, an outswing full-length ball, so just bowl an inswing length ball, and that’s exactly what I did. The right pace, the right swing, a little bit of inside edge onto his stumps. At that moment I didn’t realise what we’d done. But after about a week in Pakistan, we realised that we had really done something.” – Wasim Akram on the magic of ’92 [Wisden Archive, 2016]

*প্ৰথম ও চতুর্থ ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে এবং বাকি ছবি ইন্টারনেট থেকে