পাঁজরে কালশিটের দাগ চিনিয়েছিল হেলমেটহীন বাঙালি ওপেনারকে

প্রায় ৬৪ বছর আগের ঘটনাটা হয়তো আগেও বলেছি, তবু লিখছি, কারণ এই কাহিনি ক্রিকেট-চর্চায় জড়িয়ে-থাকা এই প্রজন্মের কাছেও নিশ্চিত বিস্ময়কর ঠেকবে। হ্যাঁ, আজও।

কুমোরটুলির বসত বাড়ি থেকে উত্তর কলকাতায় আমাদের পাড়ায় একটা স্টেশনারি দোকানে নিজের বাইকে চেপে আসতেন তিনি। ১৯৫৮ সালে প্রবল শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বোম্বাইতে হল-গিলক্রিস্ট-সোবার্স-রামাধিনদের ভয়াবহ পেস-স্পিনের ধাক্কা সামলে ৯০ রানের এক অসমসাহসী ইনিংস খেলে হারা ম্যাচ ড্র করিয়ে সবে কলকাতায় ফিরেছেন। দোকানে ঢোকামাত্র চারপাশে ভিড় ছেঁকে ধরলো। মাত্র ক’দিন পরেই ইডেনে তৃতীয় টেস্ট। চেনা-অচেনা সকলেরই প্রশ্ন — “কেমন দেখলেন হল, গিলক্রিস্টকে?” হল-গিলক্রিস্টের ভয়াবহ পেস নিয়ে কলকাতা তখন সরগরম। আপাত-নিরীহ প্রশ্নগুলো শুনতে শুনতে এরপর যে কাজটা তিনি করলেন, সেটা না দেখলে কোনওদিনই হয়তো বুঝতাম না, হেলমেটহীন এই দাপুটে ৫-ফুট-৫ বাঙালি ওপেনারের বুকের খাঁচাটা আসলে ঠিক কত বড়। পাতলা হাওয়াই শার্টের বাঁ দিকটা তুলে যা দেখালেন, এত বছর পরেও তা ভাবলে শিউরে ওঠে শরীর। ফর্সা পাঁজরে অন্তত দশ-বারোটা চাকা-চাকা কালশিটের দাগ। থেঁতো হয়ে-যাওয়া মুখে তখনও শুকনো রক্ত জমে। অবাক-বিস্ময়, আর সীমাহীন শ্রদ্ধায় এই কিশোরের চোখ শ্রদ্ধাঞ্জলির মতো অজান্তেই নেমে এসেছিল পঙ্কজ রায় নামে এক অকুতোভয় বাঙালি ওপেনারের পায়ের দিকে। কোথায় কোন স্বজাত-বিদ্বেষী ‘কাঁকড়া’ কী মন্তব্য জুড়বেন জানি না, ইতিহাস যাঁদের এককালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার হিসাবে মান্যতা দিয়েছে, সেই লিন্ডওয়াল-ডেভিডসন-হল-গিলক্রিস্ট-সোবার্স-ট্রুম্যান-স্ট্যাথাম-বেডসার-ফজল এঁদের নতুন বলে ‘ফায়ারি’ স্পেল সামলেছেন এই ভয়ডরহীন বাঙালি। ছিল না আর্ম-গার্ড, চেস্ট-প্যাড, থাই-গার্ড, হেলমেট। হাতে ছোট ছোট রবারের কাঁটাওলা গ্লাভস, বাঁশের চেরা কঞ্চি বসানো প্যাড নামক নিতান্ত পলকা প্রোটেকশনটুকু ছাড়া ওই ঘন্টায় ৯০ মাইল গতির ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শরীর বাঁচানোর অন্য কোনও ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম না-পরা এই বঙ্গ-সন্তান বুক চিতিয়ে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছেন। এখনকার যেসব ব্যাটার আপাদমস্তক নিরাপত্তার নিশ্চিন্ত খোলসে শরীর মুড়ে নভোশ্চরের বেশে মাঠে নামেন এবং কোটি কোটি টাকা কামান, তাঁরা ধারণাতেও আনতে পারবেন না, কি যৎসামান্য প্রোটেকশন নিয়েই লাল বলের বিষাক্ত ছোবল খেতে হয়েছে পঙ্কজ রায়দের।

৪৩ টি টেস্ট, ২,৪৪২ রান আর ৫ টা সেঞ্চুরির সামান্য তথ্যে কোথাও নজরে পড়বে না, ভারতবর্ষের ‘প্রথম’ টেস্ট জয়ের ঐতিহাসিক ঘটনার (বনাম ইংল্যান্ড) পিছনেও ছিল এই বাঙালির ঝকঝকে ১১১ রান।আমাদের পক্ষে কি ভোলা সম্ভব, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাদ্রাজ টেস্টে ভিনু মানকাদের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে তাঁর তৈরি ৪১৩ রানের বিশ্ব-রেকর্ডটার কথা, যা ঐশ্বর্যের তাজমহলের মতো দীর্ঘ ৫২ বছর বুকের গভীরে সন্তর্পণে আগলে রেখেছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী?

লেখালেখির প্রয়োজনে বহুবার তাঁর কাছে যেতে হয়েছে। এক বিখ্যাত দৈনিকে ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সময় বেশ কিছু ইন্টারভিউ লিখেছি। প্রচুর খেলার গল্প শুনেছি একেবারে সরাসরি তাঁর মুখ থেকেই। ১৯৬২-৬৩ সালে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে পঙ্কজদার দু’টি ইনিংসের কথা না বললে তাঁর লড়াকু মানসিকতার দৃঢ়তা আর উত্তাপ টের পাওয়া যাবে না। সেবার চারজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেসার রয় গিলক্রিস্ট, চার্লি স্টেয়ার্স, চেস্টার ওয়াটসন আর লেস্টার কিং এঁদেরকে ভারতে এনে চারটি জোনে পাঠানো হয়েছিল যাতে পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এখানকার ব্যাটাররা ম্যাচে কিছুটা অনুশীলন পায়।হায়দরাবাদের হয়ে রগচটা গিলক্রিস্ট ছিলেন আর বাংলার হয়ে খেলেছিলেন কিং। ইডেনে সেই ম্যাচের শুরুর আগেই কী কান্ড ঘটেছিল তা শোনাবো খোদ পঙ্কজদার মুখ থেকে। “ওই ম্যাচের সকালে ট্রে-র মধ্যে বেশ কিছু চকচকে নতুন বল সাজিয়ে গিলক্রিস্টকে দেওয়া হল একটা বল বেছে নেওয়ার জন্য।গিলক্রিস্ট একটা করে নতুন বল ট্রে থেকে তুলছে, ইডেনের পুরনো প্যাভেলিয়নের সিমেন্টের মেঝেতে বলটা ঠুকছে আর আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে “দেখছি, কোন বলটা রায়ের মাথার খুলিটা ফাটানোর পক্ষে সবচেয়ে শক্ত হবে।” ইডেনের দর্শক সেদিন সভয়ে তাকিয়ে দেখেছিল সাইট স্ক্রিনে পা-ছুঁইয়ে বন্য-বাইসনের মতো তীব্র আক্রোশ নিয়ে ছুটে-আসা এক উন্মাদ জহ্লাদ মানসিকতার পেসারকে হেলমেটহীন বাঙালি কীভাবে শায়েস্তা করে দু’ইনিংসেই অনবদ্য সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ছিলেন ।

মাঠে একবার তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম একটা প্রীতি ম্যাচে। কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক দলের ক্যাপ্টেন তখন আমি। উল্টো দিকের অধিনায়ক পঙ্কজদা। টসের আগে নিয়মমতো করমর্দন নয়, নিজের দুটো হাত দিয়ে, বুকের ভিতরে বেঁচে-থাকা সেই কিশোরের আশ্চর্যময়তা নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম পঙ্কজদার পুষ্ট পাঞ্জা। ভাবতে রোমাঞ্চ জাগছিল, এটাই তো সেই হাত, যা ধরে একদা ভারতীয় দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয়ের পথে চলতে শিখেছিল। কলকাতার শেরিফ, ‘পদ্মশ্রী’ পঙ্কজ রায় আজ বেঁচে থাকলে ৯৪ পূর্ণ করতেন। আমরা ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি হিসাবে অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছি ঠিকই, তবু আজ তাঁর জন্মদিনে, শুধু আবেগ নয়, আমরা যেন একটু মনে রাখার চেষ্টা করি, পেসারদের বিষাক্ত ছোবলে পঙ্কজ রায়ের ফর্সা পাঁজরে-আঁকা সেই কালশিটের রক্তজমা ক্ষতচিহ্নগুলোকে। যেগুলো আজও চিনিয়ে দেয় পাঁচ-ফুট-পাঁচ হেলমেটহীন এক অকুতোভয় বাঙালির বুকের খাঁচাটাকে।   

*প্ৰথম ছবিটি কলরব রায়ের ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে, দ্বিতীয়টি ইন্টারনেট থেকে এবং তৃতীয়টি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।