আমাদের ক্রিকেট আড্ডায় সেদিন কথা উঠল হ্যাটট্রিক নিয়ে। কে একজন বললেন “যে কোনও স্তরের ক্রিকেটেই হোক, পরপর তিন বলে তিন উইকেট তোলা কঠিন কাজ।” সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে উঠলেন “প্ল্যান করে, জায়গামতো বল করে, উইকেট হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু টানা তিন বলে প্রতিপক্ষের তিন-তিনটি উইকেট তুলে নেওয়ার মধ্যে কিছুটা ‘লাক’ থাকা দরকার।” আরেকজন বলে উঠলেন “তাই বলে বোলারের হিম্মতের দিকটাও বাদ দেওয়া যায় না। প্রেশার সিচুয়েশনে থার্ড বলটা ঠিক লাইনে রাখতেই পারে না অনেকে।” নতুন কিছু গল্পের আশায় আমি অভ্যাসমতো সকলের কথা চুপ করে শুনছিলাম । কিন্তু বাদ সাধল গৃহকর্তা । সে আমার দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল “দাদা, আপনি কিছু বলুন?”
চুপিচুপি বলি, এই ‘দাদা’ হওয়াটা মস্ত ঝামেলার ব্যাপার। ক্রিকেট নিয়ে একটু-আধটু লেখালিখি করি বলেই হয়তো ঘাড়ে এসে চাপে মন্তব্য করার এই সব উটকো ঝঞ্ঝাট। সামাল দেওয়ার চেষ্টায় বললাম “সাধারণত, একটা ইনিংসে ব্যাট্রারের সেঞ্চুরির সঙ্গে বোলারের ৫ উইকেট পাওয়াটাকে সমগোত্রীয় পারফরম্যান্স হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এক ইনিংসে একাই পরপর তিন উইকেট তোলার মধ্যে বোলারের বাহাদূরির সঙ্গে যুক্ত থাকে ‘ভাগ্য’ এবং ‘হিম্মত’ দুটোই। তবে আজ একটা ঘটনার কথা বলতে পারি, যেটা জানলে মনে হবে, হ্যাটট্রিকের কীর্তি ছাপিয়ে কখনও কখনও ‘দুর্ভাগ্য’-ও বোধহয় জড়িয়ে যায় বোলারের কপালে ” ঘটনাটা বলি —
১৯৬০ সালের ২৪ জুন (আজকের তারিখে) লর্ডস টেস্টে ঘটেছিল ঘটনাটা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ডানহাতি পেসার জিওফ গ্রিফিন পরপর তিন বলে মাইক স্মিথ, পিটার ওয়াকার এবং ফ্রেডি ট্রুম্যানকে তুলে নিয়ে হ্যাটট্রিক করলেন। ঘটনা হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেট শুরু হয়েছে ১৮৭৭ সালে। কিন্তু ১৪৫ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে কয়েকশো সেঞ্চুরি (যার মধ্যে ডবল, ট্রিপল, এমনকি চারশোও রয়েছে) হলেও ‘হ্যাটট্রিক’-এর সংখ্যা ৫০ পার হয়নি। সেই ১৮৭৯ সালে মেলবোর্ন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ‘ডেমন” পেসার ফ্রেড স্পোফোর্থ থেকে শুরু করে ২০২১ সাল্র কেশব মহারাজ পর্যন্ত বড়জোর ৪৬ বার হ্যাটট্রিক হয়েছে। শুধু সেই মুষ্টিমেয় কৃতি বোলারদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়াই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে গ্রিফিনই ‘প্রথম’ বোলার, যিনি টেস্টে ‘প্রথম’ হ্যাটট্রিক’ করলেন । কীর্তিটি আরও মনে থেকে যাবে, কারণ ক্রিকেটের ‘মক্কা’ লর্ডস মাঠে সেইটাই আজও একমাত্র টেস্ট হ্যাটট্রিক ।
এই গল্পে একটা পূর্ব-পর্ব আছে, যা গ্রিফিনের অতীতটি চেনাতে কিছুটা সাহায্য করবে । স্কুলে পড়ার সময়েই একটা দূর্ঘটনায় ডান হাতের কনুইয়ে মারাত্মক চোট পান। অস্ত্রোপচারের পরেও ডান হাতটি পুরোপুরি সোজা করতে পারতেন না তিনি। ১৯৫৯-৬০ মরশুমে (জাতীয় ক্রিকেটে তাঁর দ্বিতীয় মরশুমেই) মাত্র ১২.২৩ গড়ে ৩৫ উইকেট তোলার পুরস্কার হিসাবে ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ড সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা দলে সুযোগ পান। সিরিজের শুরু থেকেই তাঁর বোলিং ঘিরে তৈরি হল জটিল সমস্যা। খোদ লর্ডসে এমসিসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচে আম্পায়াররা ‘থ্রোয়িং’-এর কারণে ৮ বার ‘নো’ ডাকলেন । বিচলিত টিম-কর্তাদের তাগিদে ওখানে বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ আলফ গোভারের কাছে পাঠানো হল। তিনি কনুইয়ের অবস্থা দেখে বোলিংয়ের ডেলিভারি অ্যাকশনে একটু পরিবর্তন করে দিলেন। সেভাবেই খেললেন জীবনের প্রথম টেস্ট, এজবাস্টনে। নতুন অ্যাকশনে আংশিক সাফল্য পেলেন (২১-৩-৬১-১ ও ২১-৪-৪৪-৩)। তবে লর্ডসের দ্বিতীয় টেস্টে ফিরলেন নিজের পুরনো স্টাইলে এবং জীবনের দ্বিতীয় টেস্টেই করে ফেললেন নিজস্ব ‘হ্যাটট্রিক’টি। কিন্তু গন্ডগোল বাধল সেই পুরনো বোলিং অ্যাকশন নিয়ে । আম্পায়ার সিড বুলার এবং ফ্র্যাঙ্ক লি ‘থ্রোয়িং’-এর কারণে ১১ বার “নো’ ডাকলেন । পরের ট্যুর ম্যাচেও ‘নো’ ডাক হজম করতে হল তাঁকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, যে কোনওক্রমে ‘আন্ডার-আর্ম বোলিং করে ওভার শেষ করতে হয় তাঁকে।
আর কোনওদিন টেস্টে ফেরা হল না জিওফ গ্রিফিনের । হ্যাটট্রিক-টেস্টই হয়ে রইল তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট।