টেস্ট-ক্রিকেটে একই ম্যাচে সবচেয়ে বেশি স্টাম্পিং করবার রেকর্ড কোন উইকেট-রক্ষক করেছেন? ভারতের কিরণ মোরে, ছ’টা, ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মাদ্রাজে। জানেন কী তাঁর আগে কার ছিল এই রেকর্ড? তিনিও আরেক ভারতীয় উইকেট-রক্ষক, যিনি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই মাদ্রাজেই একই টেস্টে পাঁচটা স্টাম্পিং (সবকটাই ভিনু মানকড়-এর বোলিংয়ে) ক’রে এই ব্যাপারে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। এই বাবদে প্রবীর (‘খোকন’) সেন প্রায় ৩৬ বছর ধরে ঐ প্রথম স্থানটা দখল করে রাখবার পর আরেক ভারতীয়ের কৃতিত্বের ফলে আজ তিনি দ্বিতীয় স্থানে। আসুন, আজকে এই ‘খোকন’-এর কথা একটু বলি।
সালটা ১৯৪৭, ‘স্বাধীন বেশে ডনের দেশে’ পৌঁছল ভারতীয় ক্রিকেট দল, তাদের প্রথম পাঁচ-টেস্টের সিরিজ খেলতে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া সফরে, এবং প্রথমবার বিমানে চেপে (তার আগে পর্যন্ত জাহাজেই বিদেশ-সফরে যেত ভারতীয় দল)। আরো এক ‘প্রথম’ ঘটল –ভারতীয় দলের হয়ে (সাড়ে-২১ বছরের ‘খোকন-খোকন’ চেহারার সফরকারী দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য) প্রথমবার এক বঙ্গসন্তান টেস্ট-ক্রিকেটের আঙিনায় পা রাখলেন, উইকেট-রক্ষক হিসেবে – মেলবোর্নের তৃতীয় টেস্টে ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারি, সফরকারী দলের নির্বাচিত প্রথম উইকেট-রক্ষক জামশেদ (‘জেন্নি’) ইরানির জায়গায়।
ঐ সফরে অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যদলের বিরুদ্ধে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে বিপক্ষদলের দ্বিতীয় ইনিংসে ‘খোকন’ এমন একটা কাজ করে ফেলেছিলেন যা আর কোনও ভারতীয় উইকেট-রক্ষক কখনও করে উঠতে পারেননি – ব্র্যাডম্যান স্টাঃ সেন বো মানকড় ১২ – দিনটা ছিল ২৭শে অক্টোবর, ১৯৪৭ – খোদ ডনকে স্টাম্পড আউট করা।
জীবনের প্রথম টেস্টে তাঁর দুই শিকার – অজিদের প্রথম ইনিংসে অল-রাউন্ডার রন হ্যামেন্স-কে স্টাম্পড আউট করেন ও দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যাচ ধরে ফেরান সিড বার্নেস-কে – উভয় ক্ষেত্রেই বোলার ছিলেন অধিনায়ক লালা অমরনাথ।
সিরিজের বাকি দুই টেস্টেও তিনি খেলেন। অ্যডিলেডে চতুর্থ ম্যাচে (বিজয় হাজারে-র দু’ইনিংসেই শতরানের জন্য যা ভারতীয় ক্রিকেটে আজও বিখ্যাত) প্রথম ইনিংসে অনভ্যস্ত তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে কিথ মিলার-এর বলে ‘গোল্ডেন ডাক’ ক’রে তিনি বোল্ড হন। আর মেলবোর্নের পঞ্চম-তথা-শেষ ম্যাচে অজিদের একমাত্র ইনিংসে (১২৮ আট-বলের ওভারে) মোট ৫৭৫/৮ রানের মধ্যে মাত্র চারটে বাই-রান ছাড়েন প্রবীর – ভারতের (গুল মহম্মদ ও কিষেণচাঁদ বাদে) আটজন খেলোয়াড় বোলিং করেন – চারটে ক্যাচও তিনি ধরেন। সিরিজে তিন টেস্টে তাঁর শিকার ছিল ছ’টা – পাঁচটা ক্যাচ ও একটা স্টাম্পিং – অবশ্য (চতুর্থ ও পঞ্চম ম্যাচে ভারত ইনিংসে হারে ব’লে) চারটে মাত্র ইনিংসে তিনি কীপিং করবার সুযোগ পান।
সেই সিরিজে ও সফরে ব্যাট হাতে প্রবীর কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হন – টেস্টে ৫.৬০ গড়ে ৩৩ ও সফরে ৯.০০ গড়ে মোট ৮১ রান করেন। কিন্তু তাঁর উইকেট-রক্ষণ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটবোদ্ধাদের নজর কেড়েছিল। (ব্র্যাডম্যানের খুবই পছন্দের) বিপক্ষীয় অজি কীপার ডন ট্যালন তাঁকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দেন – প্রবীরের ভাষায়: “Tallon changed my stance and his coaching improved me 300 percent.”। আর (দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালের প্রবাদপ্রতিম) প্রাক্তন অজি কীপার বার্ট ওল্ডফিল্ড খুশি হয়ে প্রবীরকে উপহার দেন একজোড়া উইকেট-কীপিং গ্লাভস। তবে প্রবীরের ঐ সফরের সবচেয়ে বড় পাওনা বোধহয় ছিল সেই “ব্র্যাডম্যান স্টাঃ সেন বো মানকড় ১২” – তিনি নিজেই নাকি সেই কথা স্বীকার করেন।
কেমন কীপিং করতেন তিনি? নামে ‘খোকন’ হলেও উইকেটের পেছনে তিনি কিন্তু ছিলেন যথেষ্ট পরিণত ও দক্ষ যদিও তখন তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল সীমিত। সাড়ে-পাঁচ ফুট উচ্চতার ছোটখাট ও একটু গাঁট্টাগোট্টা ধরণের চেহারা হলেও তিনি খুবই তৎপর ছিলেন এবং বেশ কয়েকটা চটপটে ক্যাচ ও দ্রুতগতি স্টাম্পিং করেছিলেন যাতে দলীয় বোলাররা বেশ উৎসাহ পান। মিডিয়াম-পেস (তখন ভারতে প্রকৃত পেসার কেউ ছিলেন না) ও স্পিন এই দু’ধরণের বোলিং সামলাতেই তিনি সুদক্ষ ছিলেন। মাঠে তাঁর প্রাণবন্ত হাবভাব বোলারদের চাগিয়ে তুলতে সাহায্যও করত।
আরেকটা তথ্য – ভারতের প্রথম ১২টা টেস্টে পাঁচজন উইকেট-রক্ষক [জনার্দন নাভলে ১৯৩২-১৯৩৩ দু’টো, দিলাওয়ার হুসেন ১৯৩৩-১৯৩৬ তিনটে, দত্তারাম হিন্ডলেকর ১৯৩৪-১৯৪৬ চারটে, খুরশিদ মেহেরহোমজি ১৯৩৬-১৯৩৬ একটা ও জামশেদ ইরানি ১৯৪৭-১৯৪৭ দু’টো] খেলাবার পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এই সময়ে প্রবীর সেন মোট ১৪টা টেস্ট খেলেন, তার মধ্যে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে অস্ট্রেলিয়াতে তিনটে এবং দেশে (জন গডার্ড-এর) ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাঁচটা, এই পরপর আটটা ম্যাচ ছিল। এটা অবশ্যই তাঁর দক্ষতা ও ধারাবাহিকতার একটা পরিচয়। ১৯৫২ সালে ভারতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফর (সঙ্গের ছবিটা দেখুন) করতে গিয়েও তাঁর কীপিং সেদেশের ক্রিকেট-রসিকদের নজর কেড়েছিল।
তিনি যে ‘ফাঁকা মাঠে দৌড়েছিলেন’, তা নয় – ছিল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা – পি জি (‘নানা’) যোশী (ব্যাটিংটা নেহাৎ মন্দ করতেন না), মাধব মন্ত্রী (ওপেনারও ছিলেন), বিজয় রাজিন্দরনাথ, এব্রাহিম মাকা এঁরাও ১৯৫১ ও ১৯৫২ সালে দুয়েকটা ক’রে টেস্ট খেলেন। কিন্তু ঐ চার বছরে খোকন সেনই ছিলেন ভারতের প্রথম ও প্রধান উইকেট-রক্ষক, যে জায়গাটা ১৯৫৫ সাল থেকে নিয়ে নেন নরেন তামহানে।
টেস্ট-জীবনে ১৪ ম্যাচে মোট ৩১টা শিকার (২০টা ক্যাচ ও ১১টা স্টাম্পিং – বুঝতেই পারছেন ভারতীয় বোলিং-আক্রমণ ছিল খুবই স্পিন-নির্ভর), এর মধ্যে ভিনুর বোলিংয়েই ১২টা, এছাড়া দাত্তু্ ফাদকরের পাঁচটা, অমরনাথের চারটে, মিডিয়াম-পেসারত্রয় রমেশ দিভেচা তিনটে, গুলাবরাই রামচাঁদ ও সি আর রঙ্গাচারির দু’টো করে, হাজারে, সারওয়াতে ও নীরদ (‘পুঁটু’) চৌধুরির বোলিংয়ে একটা করে শিকার ধরেন। ১৯৪৯ সালের ২৮শে জানুয়ারি তারিখে মাদ্রাজে “জেফ স্টলমেয়ার কট সেন বোল্ড চৌধুরি ১৬০” ছিল “কট মার্শ বোল্ড লিলি”-র টেস্ট-ক্রিকেটে সর্বপ্রথম ভারতীয়-বাঙালি সংস্করণ – মনে রাখুন! টেস্টে অবশ্য ব্যাট হাতে তাঁর ভূমিকা যৎসামান্যই ছিল – ১১.৭৮ গড়ে মোট ১৬৫ রান, সর্বোচ্চ ২৫ [১৯৫২ সালে দিল্লিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নবম উইকেটে ৩৪ রানের জুটির সিংহভাগ] – এবং এই ‘ঘাটতি’ হয়ত তাঁর টেস্ট-জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার পথে খানিকটা বাধা হয়েই দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কলকাতা টেস্টটাই তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট-ম্যাচ – রামচাঁদের বোলিংয়ে একটা করে স্টাম্পিং (মাহমুদ হুসেন) ও ক্যাচ (আমির এলাহি) ছিল তাঁর শেষ টেস্ট-শিকার।
১৯৪৩-৪৪ থেকে ১৯৫৭-৫৮ এই সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলায় ৮২টা ম্যাচে ১৪৪টা শিকার (১০৮টা ক্যাচ ও ৩৬টা স্টাম্পিং) এবং ব্যাটিংয়ে ২৩.২৪ গড়ে মোট ২,৫৮০ রান, তিনটে শতরান, সর্বোচ্চ ১৬৮ [১৯৫০-৫১ মরশুমে বিহারের বিরুদ্ধে নবম উইকেটে ২৩১ রানের বাংলার রেকর্ড জুটির সিংহভাগ] এই নিয়ে তিনি ক্রিকেট-জীবন শেষ করেন। বিহারের বিরুদ্ধে মাত্র সাড়ে-১৭ বছর বয়সে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক-হওয়া খোকন তাঁর দ্বিতীয় প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচেই (সি কে নাইডু-র) শক্তিশালী হোলকার-এর বিরুদ্ধে ২২৫ মিনিটে ১৪২ রান করেছিলেন। ওঁর শেষ প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ ছিল ১৯৫৭-৫৮ মরশুমে রঞ্জি ট্রফির সেমি-ফাইনাল, সার্ভিসেস দলের বিরুদ্ধে – বাংলার অধিনায়ক ছিলেন পঙ্কজ রায় – প্রবীর ব্যাটিংয়ে করেছিলেন ৫৭ রান, উইকেটের পেছনে কোনও শিকার ছিলনা।
১৯৫১-৫২ মরশুমের শেষে “Indian Cricket” পত্রিকা তাঁকে ‘Cricketer of the Year’ নির্বাচিত করে। ১৯৫২-৫৩ মরশুমে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি বাংলার অধিনায়ক ছিলেন। সেবার এক রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে ইডেনে বাংলা অল্পের জন্য (সি কে নাইডু-র) শক্তিশালী হোলকার-এর বিরুদ্ধে ফাইনালে হেরে না গেলে বাংলার রঞ্জি-জয়ী প্রথম উইকেট-রক্ষক অধিনায়ক (১৯৮৯-৯০ মরশুমের সম্বরণ ব্যানার্জি না হয়ে) প্রবীর সেন-ই হতেন। সেই ম্যাচের বাংলায় অসাধারণ এক বর্ণনা পড়তে হ’লে অজয় বসু-র “ব্যাটে বলে ক্রিকেট”-এর শরণাপন্ন হতে হবে।
এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা জানাই। ১৯৫৪-৫৫ মরশুমে ওড়িশার বিপক্ষে কটকে এক রঞ্জি ম্যাচে খোকন সেন এক ‘আজব খেল’ দেখান – বোলিং ক’রে নেন ৩.৪-১-৪-৩ এবং (টমাস লংফিল্ড-এর পর বাংলার দ্বিতীয় বোলার হিসেবে) প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে হ্যাট-ট্রিক করেন – প্রথমজন স্টাম্পড ও পরের দু’জন বোল্ড আউট। তবে ঐ ম্যাচে তিনি বাংলা দলের designated wicket-keeper ছিলেন না।
প্রথম-শ্রেণীর খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পরেও ষাটের দশকের কলকাতার ক্লাব-ক্রিকেটে তিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৭শে জানুয়ারি, একটা ম্যাচের পরে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে যান। তাঁর থেকে ১৯ বছরের ছোট, তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভাই, বাঁ-হাতি ব্যাটার, রণবীর সেনও ষাট-সত্তরের দশকে গোটা-দুয়েক রঞ্জি ম্যাচে বাংলার হয়ে খেলেছেন।
অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় (বর্তমানের বাংলাদেশে) ১৯২৬ সালের ৩১শে মে তারিখে জন্মগ্রহণ করা (পঙ্কজ রায়ের থেকে বয়সে ঠিক দু’বছরের বড়) প্রথম ভারতীয়-বাঙালি টেস্ট-ক্রিকেটারের সম্মানে নামাঙ্কিত কলকাতায় বাৎসরিক “পি সেন মেমোরিয়াল ট্রফি” প্রতিযোগিতাতে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলে গেছেন শচীন তেনডুলকর, চামিন্ডা ভাস, মহেন্দ্র সিং ধোনি এঁদের মতন বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটাররা।
প্রবীর (খোকন) সেনের জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করতে (ও করাতে) এই আমার সামান্য প্রয়াস।
*সমস্ত ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া