কবিপক্ষ এসে গেল, আসন্ন রবীন্দ্র জন্মোৎসবের হাত ধরে। বাংলা সাহিত্যের নানা ‘শাখা-প্রশাখায় শিহরণ’ জাগানো এই দিনে আজ বেশি করে মনে হচ্ছে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের কথা, মনে পড়ছে পূর্বপথিকদের কয়েকজনের নাম – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, কুলদারঞ্জন রায়, বেরী সর্বাধিকারী, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রাখাল ভট্টাচার্য, অজয় বসু, মতি নন্দী। ভাবতে গিয়ে মনে এল আরেকজন সাহিত্যিকের নাম যাঁকে সাহিত্যরসিক বাঙালি প্রধানত চেনে ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’ ধারার “কল্লোল-যুগ”-এর কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক হিসেবে এবং পরবর্তীকালের প্রবল জনপ্রিয় রামকৃষ্ণ-জীবনীকার রূপে।হ্যাঁ, যাঁর কথা আমি বলছি তাঁর নাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত [১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৩ – ২৯শে জানুয়ারি, ১৯৭৬] – মনে পড়ছে তাঁর “ছন্নছাড়া” কবিতার সেই লাইনগুলো: “… কারা ওরা?/ চেনেন না ওদের?/ ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের, এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে। / ওদের কিছু নেই/ ভিটে নেই, ভিত নেই, রীতি নেই, নীতি নেই,/ আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই/ শ্লীলতা-শালীনতা নেই/ ঘেঁষবেন না ওদের কাছে। … রক্তে মাখামাখি সেই দলা-পাকানো ভিখিরিকে/ ওরা পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সির মধ্যে তুলে নিল। চেঁচিয়ে উঠল সমস্বরে, আনন্দে ঝংকৃত হয়ে,/ প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে/ … তারপর সহসা শহরের সমস্ত কর্কশে-কঠিনে/ সিমেন্টে-কংক্রিটে/ ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে-দেয়ালে-দেয়ালে/ বেজে উঠল এক দুর্বার উচ্চারণ/ এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি/ প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে,/ প্রাণ থাকলেই স্থান আছে, মান আছে/ সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও/ আছে অস্তিত্বের অধিকার। … শুধু প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ/ এক ক্ষয়হীন আশা/ এক মৃত্যুহীন মর্যাদা।” – বহুদিন আগেকার জনপ্রিয় সেই এক উচ্চারণ, “পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি, চল পানসি বেলঘরিয়া।
অনেকেই হয়ত জানেন না যে, অচিন্ত্যকুমার একসময়ে ক্রীড়া-সাংবাদিক হিসেবে কলকাতার একটি সংবাদপত্রে কাজও করেছেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় তিনি খেলার ধারাভাষ্য দিতেন, ম্যাচ-প্রতিবেদনও লিখতেন। এই অচিন্ত্যকুমার সম্বন্ধে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম প্রাণপুরুষ শঙ্করী্প্রসাদ বসুর “রমণীয় ক্রিকেট” বইয়ের ১৯৬২ সালের সংস্করণ থেকে একটি লাইন তুলে দিই: “অচিন্ত্যকুমার ১৯৩৩-৩৪ সালের জার্ডিন দলের ভারত-সফরের কিছু বিবরণ লিখেছিলেন ‘মৌচাক’-এর পৃষ্ঠায় ছোটদের জন্য। বড়দের জন্য নয় বলে কে?”
ক্রিকেটের উপরে একটি বইও আছে অচিন্ত্যকুমারের, “মৃগ নেই মৃগয়া”। বইটার ১৯৬৫ সালের সংস্করণ থেকে প্রচ্ছদ ও সূচীপত্রের একাংশ তুলে দিলাম – প্রচ্ছদকার বিখ্যাত শিল্পী খালেদ চৌধুরী।
বইটার প্রথাগত ‘পাঠ-প্রতিক্রিয়া’ লেখবার দুঃসাহস আমি করছিনা – আমার এই দুর্বল প্রয়াস কেবল একঝলক ফিরে দেখার মাধ্যমে এই শতাব্দীর বাংলাভাষী ক্রিকেট-প্রেমীদের মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। ১৯৭০ সালের ১৬ই জানুয়ারি তারিখে হাতে পাওয়া থেকে শুরু করে বিগত ৫২ বছরে অগুন্তিবার পড়া এই বইয়ের সাহিত্যগুণের কিছু উদাহরণ দেওয়ার জন্য সামান্য কয়েকটা অংশের বর্ণনা নিচে পরপর তুলে দিচ্ছি।
কেন ব্যারিংটনের ব্যাটিঁংয়ের সঙ্গে জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মেলানোর এই প্রচেষ্টা আর কেউ করেছেন কি! সম্ভাবনা কম।
চিরাচরিত ‘লাস্ট ম্যান’ চন্দ্রশেখরের অকুতোভয় ইনিংসের অন্তর্নিহিত ক্রিকেটমাহাত্ম্যের এই দর্শন বাংলা-পড়তে-না-পারা ইডেনের বড় প্রিয় মানুষ ‘চন্দ্র’ তো জানতে পারলেন না – আপনারাই জানুন।
স্থিতপ্রজ্ঞ কলিন কাউড্রের ধৈর্যশীল এবং ধৈর্য-দাবি-করা ইনিংসের বর্ণনার সঙ্গে তাঁর ধ্রুপদী ধাঁচে নান্দনিক বাউন্ডারি মারার রসগ্রহণ করে নিন একবার।
বেশ খানিকটা অন্যরকম ম্যাচ-রিপোর্ট দেখুন ইডেনে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া টেস্টের প্রথম দিনের খেলা নিয়ে।
ক্রিকেটের আদর্শগত, কৌশলগত ও দলসংহতির প্রসঙ্গও যে বাদ যায়নি, তার কয়েকটা প্রমাণও পেশ করি। আম্পায়ারিং নিয়ে খেলোয়াড়দের মনোভাব, আক্রমণাত্মক বনাম রক্ষণাত্মক খেলার ধরণ এবং ব্যক্তির ওপরে দলের (তথা দেশের) স্থান এই নিয়েও লিখেছেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, টেনে এনেছেন প্রাসঙ্গিক ঘটনা, ক্রিকেটীয় ব্যক্তিত্বদের ও রুদ্ধশ্বাস বিখ্যাত ম্যাচের বর্ণনা।ইংরেজদের ‘Spirit of Cricket’ এবং গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন এই দুইয়ের মূল সুরটা যে একই, এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল এবং সেটা বোঝাতে মেলবন্ধনের প্রয়াসও এই বইতে রয়েছে। “It isn’t cricket” বলতে বৃহত্তর অর্থে জীবনে কি বোঝায়, সে ব্যাপারে তাঁর মত তিনি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করেছেন, সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন ‘স্পোর্টসম্যান’ বলতে তিনি কি মনে করেন। তাঁর এই মত নিয়ে অনেকেই বিরোধিতা করতে পারেন, বিশেষত বিগত অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী বিশ্ব-মানসিকতায় আমূল পরিবর্তনের কারণে, কিন্তু তাঁর সময়ে ঐ জাতীয় মতটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচলিত বলে গণ্য করা হ’ত।
উল্লেখ রয়েছে মাঠের মধ্যে ক্রিকেটার বনাম আম্পায়ার সংঘাতের এবং সেই প্রসঙ্গে তাঁর মতামত স্পষ্ট, এ নিয়ে যতই বিরুদ্ধ মত থাকুক না কেন। ক্রিকেট মাঠে আম্পায়ারদের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি অকপটভাবে দ্বিধাহীন।
‘Bright Cricket’ নিয়ে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সোবার্সের বক্তব্যটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
‘Team First’ এই মন্ত্রের অসাধারণ এক উদাহরণ দিয়েছেন তিনি ১৯৬০-৬১ সিরিজের অ্যাডিলেডের চতুর্থ টেস্টের রুদ্ধশ্বাস শেষ দিনের শেষ ওভারের শেষ বল থেকে।
এমন অজস্র মণিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে ১৬০ পৃষ্ঠার এই বইটাতে। বইয়ের একদম শেষের (“ক্রিকেট” শিরোনামের) কবিতাটার “করব না কভু মাথা হেঁট/ খেলে যাব খেলে যাব রঙিন ক্রিকেট” লাইনদুটোর সঙ্গে কোথাও কোনওভাবে কি এই রচনার শুরুতে উল্লেখ করা (“ছন্নছাড়া” কবিতার) “প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে,/ প্রাণ থাকলেই স্থান আছে, মান আছে/ সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও/ আছে অস্তিত্বের অধিকার।“ লাইনগুলো মিলে যায়? আপনারাই ভেবে দেখুন।