তিনি নাকি ‘বৃদ্ধ’ হয়েছেন। তাই জাতীয় দলে আর নাকি তাঁকে নেওয়া যাবে না। আকারে ইঙ্গিতে নাকি সেকথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। অথচ, সেই ঋদ্ধিমান সাহাই কিনা আইপিএলের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ম্যাচে জয়ের মঞ্চ গড়ে দিলেন!
হায়দরাবাদের ১৯৫/৬ তাড়া করতে গিয়ে একে একে ফিরে গেলেন শুভমান গিল, হার্দিক পান্ডিয়া। অথচ, শুরু থেকেই পাল্টা আক্রমণ যেন ফিরিয়ে দিলেন বাংলার লাজুক ছেলেটি। একদিকে রানের ঝড় তোলা। আবার অন্যদিকে আর যেন উইকেট না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। কাজটা খুব সহজ ছিল না। ৬৮ রানের সেই দুরন্ত ইনিংসে ঝড়ও ছিল, আবার ভারসাম্যও ছিল। এই দুরন্ত লড়াইয়ের মঞ্চটা তৈরি না হলে পরেরদিকে রাহুল তেওয়াটিয়া বা রশিদ খানের পক্ষে এমন রুদ্ধশ্বাস জয় এনে দেওয়া সম্ভবই ছিল না।
হ্যাঁ, এভাবেও ফিরে আসা যায়। সেটাই যেন দেখিয়ে দিলেন ঋদ্ধিমান। অথচ, উপেক্ষার কত দীর্ঘ পথই না তাঁকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে।
আইপিএলে দশটি দল। একেক দলে যদি দু’জন করেও উইকেট কিপার থাকেন, তাও তো কুড়িজন উইকেট কিপার দরকার। অথচ, আইপিএলের নিলামে কোনও দলই তাঁর নামে হাত তুলল না! দেশের একনম্বর উইকেট কিপার। তিনি কিনা আনসোল্ড!
পরের দিন আবার নিলামে তাঁর নাম উঠল। আগেরদিন হয়ত অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির পছন্দের তালিকায় তিনি ছিলেন না। হয়ত তাঁদের মাথায় অন্য কোনও নাম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যে নিলামে ঋদ্ধিমান সাহার নাম আবার উঠবে, এটা তো জানাই ছিল। তখন তো ঝাঁপানোই যেত।
কিন্তু দ্বিতীয় দিনও কী চরম উদাসীনতা। তাঁর নামটা যখন উঠল, কলকাতার কর্তাদের এমন হাবভাব যেন ঋদ্ধিমান সাহার নামটাই প্রথমবার শুনছেন। আগেরবার যে দলে ছিলেন, সেই সানরাইজার্স হায়দরাবাদও মুখ ঘুরিয়ে নিল। চেন্নাইয়ে ছিলেন তিনবছর, পাঞ্জাবে চার বছর। তারাও নির্লিপ্ত। ঋদ্ধিমান সাহা কি তবে বাতিলের তালিকায় চলে গেলেন! নম নম করে হাত তুলল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। তারপর হাত বাড়াল আইপিএলের নতুন দল গুজরাট টাইটান্স। যাক, ঋদ্ধিমান সাহার তাহলে একটা হিল্লে হল। কিন্তু তারপরও কি উপেক্ষার শেষ আছে! প্রথম পাঁচ ম্যাচে তাঁর জায়গাই হল না। খেলানো হল ম্যাথু ওয়াডেকে। যিনি একটি ম্যাচে করেছেন ৩০, বাকি চারটি ম্যাচে চূড়ান্ত ব্যর্থ।
একটা প্রকাণ্ড ছায়া কত মানুষের জীবনে কালো ছায়া হয়ে নেমে আসে। যেমন বিষেন সিং বেদি নামক প্রকাণ্ড ছায়ার আড়ালে থেকে টেস্ট খেলাই হল না রাজিন্দার গোয়েল বা পদ্মাকর শিভালকারের। বেঙ্কটপতি রাজুর ছায়ায় হারিয়ে গেলেন উৎপল চ্যাটার্জি। ঋদ্ধিমানের জীবনের সঙ্গেও তো তেমনই ট্র্যাজেডি জড়িয়ে সেই অভিষেক লগ্ন থেকেই। টেস্ট অভিষেক হয়েছে সেই ২০১০ এর গোড়ায়। ১২ বছরে কিনা খেলেছেন মাত্র ৪০ টি টেস্ট। সেই এম এস ধোনির প্রকাণ্ড ছায়ায় আড়ালেই থাকতে হয়েছে। যেটুকু সুযোগ এসেছে, ধোনি অবসরে যাওয়ার পর। টেস্টে যদিও ভাগ্য কিঞ্চিৎ সুপ্রসন্ন ছিল, একদিনের ক্রিকেটে তো সেটুকুও ছিল না। খেলেছেন মাত্র ৯টি একদিনের ম্যাচ। তাও শেষ একদিনের ম্যাচ খেলেছেন আট বছর আগে!
বেশ মুখচোরা, লাজুক। একেবারেই ডাউন টু আর্থ বলতে যা বোঝায়, তাই। বিতর্ক থেকে হাজার মাইল দূরে তাঁর অবস্থান। নিজের বঞ্চনার কথা মুখ ফুটে কখনও বলেন না। কোনও তারকার ঘনিষ্ঠবৃত্তে থাকার চেষ্টা করেননি। নিজের শহরের বোর্ড সভাপতি। তারপরেও তাঁর ওপরই নেমে আসে উপেক্ষার শীতল স্রোত। হঠাৎ তালেবর হয়ে ওঠা সাংবাদিকও কি অবলীলায় তাঁকে হুমকি দিতে পারেন। ইন্টারভিউ না দিলে তিনি নাকি ‘দেখে নেবেন’। এমন ঠান্ডা হুমকি অন্য কাউকে দেওয়া যেত! দেওয়ার কথা ভাবা যেত! অথচ, ঋদ্ধিমান সাহাকে দেওয়া যায়। কারণ, তিনি শান্ত, ভদ্র।
অথচ, প্রয়োজনে বাইশ গজে সংহার মূর্তিও ধারণ করতে জানেন। সেই সংহার মূর্তিই যেন টের পেল হায়দরাবাদ। শুধুই কি হায়দরাবাদ! ঋদ্ধিমানের লড়াইটা যে ছিল আরও অনেকের বিরুদ্ধেই। জয়ের পরেও হুঙ্কার নয়। আস্ফালন নয়। নিজের টুইটারে শুধু লিখলেন, এখনও অনেক পথ বাকি। হ্যাঁ, ওই ছোট্ট তিনটে শব্দই যেন হাজার শব্দের সমান।