কিছু কিছু তারিখ থাকে, একটা দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যার মূল্য অপরিসীম। ২৬শে ফেব্রুয়ারি তেমনই একটা উৎসবের তারিখ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে। ঘটনাটা একটু বলা যাক।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ‘টেস্ট’ খেলার অধিকার পায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯২৮-২৯ সালে। এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজের তিনটি ম্যাচেই চূর্ণ হয় ইনিংসে হেরে। পাল্টা সফরে আসে ইংল্যান্ড ১৯৩০ সালে। কিন্তু বার্বাডোজে প্রথম টেস্টে নবাগত একটি ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় প্রবল বিক্ষোভ। স্থানীয় একজনের জায়গায় কেন একজন জ্যামাইকান, এই অসহিষ্ণুতা আর চিৎকারের মধ্যে দিয়ে ওয়ান-ডাউনে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন ২১ বছরের তরুণ জর্জ হেডলি। একটু বেহিসাবী আক্রমণের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মাত্র ২১ রানেই আউট হন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে আরম্ভ হয় আরও চিৎকার আর বিদ্রূপ-বর্ষণ। সেই চাপ মাথায় নিয়ে নাতিদীর্ঘ উচ্চতার একটি শরীর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসে গড়ে ফেলে এক অমূল্য কীর্তি। দেশের ‘প্রথম ব্যাটার’ হিসাবে আবির্ভাব টেস্টেই ১৭৬ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেন হেডলি। ম্যাচ ড্র।
পরের টেস্টে হেডলি রান পেলেন না, ফলে টেস্ট হাতছাড়া হল আবার। এরপর জর্জটাউনে তৃতীয় টেস্টে আজকের তারিখে (২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০) যে কান্ডটা ঘটল, তা আজও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মুক্তি-যুদ্ধের সঙ্গীত। দু’ইনিংসে অনবদ্য জোড়া সেঞ্চুরি (১১৪ আর ১১২) হাঁকিয়ে হেডলি দেশকে উপহার দিলেন টেস্ট ক্রিকেটের ‘প্রথম’ জয় ! ২৮৯ রানে জয়ের উৎসব যেন বদলে যায়, সাদা চামড়ার বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের দুর্বিনীত প্রতিবাদে। অবশ্য আরও দু’জনের কথাও এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে। একজন ক্লিফোর্ড রোচ (ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ‘প্রথম’ টেস্ট সেঞ্চুরিকারী) যিনি প্রথম ইনিংসে করেন ২০৯ এবং পরবর্তীকালে ‘স্যার’ পাওয়া লিয়ারি কনস্ট্যানটাইন, যিনি দু’ ইনিংস মিলিয়ে সেই টেস্টে পান ৯ উইকেট। ১-১ অবস্থায় জ্যামাইকায় ‘টাইমলেস’ টেস্টেও হেডলি অনবদ্য ‘ডবল’ (২২৩) সেঞ্চুরি করায় ম্যাচ অমীমাংসিত থাকে। সিরিজে ৮৭.৮৭ গড়ে জর্জ হেডলি করেন ৭০৩ রান। বিদ্রূপকারীরাই এবার মাথায় তুলে নেয় তাঁকে ।
বলা দরকার, বিশ্বযুদ্ধের কারণে হেডলির ক্রিকেট জীবন যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু তার মধ্যেই মাত্র ২২ টি টেস্টে তাঁর ব্যাটে যেভাবে রানের রংমশাল জ্বলেছে, তাতেই তাঁর বৈভব, বিক্রম এবং সৌন্দর্য সুঘোষিত। ভাবা যায়, এখনও ক’জন ক্রিকেটারের ৬০.৮৩ গড়ে ২,১৯০ রান আছে, যার মধ্যে ১০টি সেঞ্চুরি এবং ৫টি ‘ফিফটি’? তিনিই একদা লর্ডসকে চমকে দিয়েছিলেন ‘প্রথম ব্যাটার হিসাবে দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। তিনিই ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘প্রথম’ কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। আসলে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানশিপের ‘মানদন্ড’ ছিলেন তিনি। কাঁধে দেশের দায়িত্ব নেওয়ার নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তোলার কারণে তাঁকে টিমমেটরা ডাকতেন ‘অ্যাটলাস’ বলে। ইংরেজ সংবাদ মাধ্যমে তাঁকে ডাকা হত ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা এক সময় উল্টো দাবি তোলে—কেন ডন ব্র্যাডম্যানকে বলা হবে না, ‘হোয়াইট হেডলি’?