ভিশনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হোক

গত বছর মধ্য জুলাই-এর এক পড়ন্ত বিকেল। ফোনের অপর প্রান্তে সেদিনই সিএবিতে নিজের ইস্তফা পত্র জমা করে আসা বাংলার সদ্য প্রাক্তন কোচ অরুণলাল। দৃপ্তকন্ঠে বললেন ‘এই বাংলা দলের প্রতিটা নিয়মিত বোলারের যোগ্যতা আছে ভারতের হয়ে খেলার’। বছর ঘোরার আগেই বাংলা আবার রনজি ট্রফির ফাইনালে, শেষ তিন বছরে দুবার এবং আর একবার সেমিফাইনাল থেকে বিদায়। অন্যদিকে শাহবাজ ইন্ডিয়া খেলে ফেলেছেন, ঈশান আগেই বয়সভিত্তিক পর্যায় খেলেছেন, মুকেশ স্কোয়াডে জায়গা করে নিয়েছেন, আকাশদীপও সজোরে কড়া নাড়ছেন। ব্যাটিং বিভাগে অভিমন্যু ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জোরে বাংলাদেশ সফরে ভারতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। প্রবলভাবে উঠে আসছেন সুদীপ কুমার ঘরামী। উইকেটের পেছনে ভরসা জোগাচ্ছেন অনুর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসা অভিষেক পোড়েল। এছাড়াও আছেন কাজী জুনাইদ সইফি, প্রদীপ্ত প্রামানিকরা। এক কথায় বর্তমানে মনোজ-অনুষ্টুপকে বাদ দিলে বাংলা দলে যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটা হলো, তার অনেকটাই ভিশন-২০২০। আর এই অবশিষ্ট অংশটা এতটাই শক্তিশালী যে সামি-ঋদ্ধি-সুদীপের (চ্যাটার্জি) অবদান ছাড়াই দলটা ফাইনালে উঠলো।

 

বিদেশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা নিয়ে আমরা প্রচুর আলোচনা করি কিন্তু সিএবি নিয়ে? ২০১৪, সৌরভ গাঙ্গুলির স্বপ্নের প্রোজেক্ট ভিশন-২০২০ সবে ডানা মেলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে খেলোয়াড় নির্বাচনের সময় রণদেব বসু (দিন্দা এপিসোডের জন্য অনেকেই যাঁকে দায়ী করেন), নিমরাজি ওয়াকার ইউনিসকে প্রায় জোর করলেন ছেঁড়া জুতো পড়ে আসা এক পেসারকে ক্যাম্পে রাখার জন্য। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হলো না। জানা গেল ছেলেটা অপুষ্টিতে ভুগছে এবং সেই সঙ্গে আছে হাড়ের শোথ রোগ, একজন ফাস্ট বোলারের এর থেকে প্রধান অন্তরায় আর কী হতে পারে! এবার রণদেব ছুটলেন প্রিয় দাদার কাছে যিনি নিজে কোনদিন প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। তিনি রণদেবকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলেন যে ছেলেটার বিষয়ে রণদেব নিশ্চিত কিনা! তারপর সেই বোলারের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার পুরো দায়ভার নিলো সিএবি। কয়েকবছরের মধ্যেই সেই পেসার, অর্থাৎ মুকেশ কুমার লাহলিতে বিরু-কে আউট করেই প্ৰথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের আবির্ভাব ঘটালেন। শুধুই মুকেশ কুমার! বিহারের সাসারাম থেকে উঠে আসা ছেলেটা যিনি দশ দিনের মধ্যে নিজের বাবা এবং দাদাকে হারিয়ে জীবন যুদ্ধে দিশেহারা, শুধুমাত্র কাজের জন্য দুর্গাপুর হয়ে কলকাতা এসেছে তাকেও খানিকটা এভাবেই রণদেব বসু ভিশন ২০২০র আবর্তে নিয়ে এলেন। আকাশদীপের জন্য সৌরভের কাছে শুধু রণদেবের সার্টিফিকেট পৌঁছায়নি, তাতে অনুমোদন ছিল ব্যাটিং পরামর্শদাতা লক্ষ্মণ-এরও। শাহবাজ, সুদীপ ঘরামী, কাজী জুনাইদ, প্রদীপ্ত প্রামানিকরাও প্রায় একইভাবে উঠে এলেন, প্রসূতিঘর সেই ভিশন-২০২০। অভিমন্যু একটু সিনিয়র হলেও তিনিও ঘুরে এসেছেন এই ক্যাম্প। অনুষ্টুপও নিজের কেরিয়ারের দ্বিতীয় পর্যায়ের সাফল্যের জন্য ভিশন-২০২০ এবং লক্ষ্মনের অবদানের কথা সরাসরি জানিয়েছেন।

পরিকল্পনা শুধু এখানেই সীমাবব্ধ ছিল না। আকাশ, মুকেশরা ভিশন-২০২০ শিবির থেকে সোজা গেলেন অনুর্দ্ধ-২৩ দলে। সেখানে তখন কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী। সেখান থেকে এই ব্যাচ যখন সিনিয়র দলের দিকে ধীরে ধীরে আসছে ততক্ষনে সিনিয়র দলে কোচ হিসেবে চলে এসেছেন শৃঙ্খলাপরায়ন লড়াকু অরুণলাল আর অনুর্দ্ধ ২৩ থেকে সিনিয়র দলে সহকারী কোচ করে নিয়ে আসা হয়েছে সৌরাশিসকে, যিনি রণদেব, লক্ষ্মণ-দের মতো এই ব্যাচকে হাতের তালুর মতো চেনেন। শেষমেষ দলটা এসে পড়েছে লক্ষ্মীর মতো লড়াকু চরিত্রের হাতে।

কিন্তু এবারের রনজি ফাইনাল দেখিয়ে দিলো শুধু লড়াকু চরিত্র, প্রতিভা আর পরিকল্পনা দিয়ে বড় প্রতিযোগিতা জেতা যাবে না। তার জন্য এই সবকিছুর সঙ্গে দরকার ম্যান ম্যানেজমেন্ট এবং সঠিক খেলোয়াড় নির্বাচন। যার দায় বর্তমান টিম ম্যানেজমেন্টকে নিতে হবে। কৌশিক ঘোষদের বাদ দেওয়া, ফাইনালে আকাশ ঘটককে খেলানোর দায় কি টিম ম্যানেজমেন্ট নেবে? কাজী জুনাইদ এর মতো প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড়কে একটার বেশি ম্যাচ খেলানো হলো না, আর যে ম্যাচে খেলানো হলো সেখানে তিনি খেললেন ওপেনার হিসেবে অনভ্যস্ত জায়গায়। এটা ঠিক যে সমুদ্র গুপ্ত ক্লাব স্তরে কিছু পারফর্ম করেই দলে এসেছেন কিন্তু তার মতো মিডল অর্ডার ব্যাটারকে হঠাৎ করে কেন ফাইনালে ইডেনের গ্রীন টপে ওপেন করতে নামিয়ে দেওয়া হলো সেটার উত্তর একমাত্র টিম ম্যানেজমেন্টই দিতে পারবে। কিন্তু তার জন্য সামগ্রিক প্রসেসটা যেন বন্ধ না হয় বা সেটাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কতটা ঠিক সেটা ভাবার প্রয়োজন আছে।

যে সৌরাষ্ট্রকে আজ নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে, ২০০৫/০৬-এ বাংলা যখন ফাইনাল খেলছে, দেবু মিত্র তখন লড়ে যাচ্ছেন দলটাকে প্লেট থেকে এলিটে তোলার জন্য। তারপর ২০০৭/০৮ থেকে পরপর দুবার সেমিফাইনালিস্ট এবং গতবার (২০১৯/২০) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগের সাত বছরে তিনবার ফাইনালে উঠে হেরে গেছে। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে দেবু মিত্রকে সামনে রেখে একটা প্রায় ১৬/১৭ বছরের একটা দীর্ঘমেয়াদি এবং নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ দলটা তিনবছরে দুবার রনজি জিতল, সঙ্গে দুজন নিয়মিত ভারতীয় দলে খেলোয়াড় উপহার দিয়েছে। কিন্তু তার আগে যথেষ্ট ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের প্রসেসটা থেকে সরে আসেনি। আর সেখানে আমরা একটা পরিকল্পিত দিশাপূর্ণ প্রজেক্টই শুরু করেছি ৭/৮ বছর আগে আর এখনই ফল(!) না পেয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠছি! উল্টে এই প্রশ্নটা করছি না যে এই যে গত ছয় সিজনে চারবার সেমিফাইনাল খেললাম, এটা এর আগে শেষ কবে হয়েছে?

হ্যাঁ, ফাইনালে ভুল হয়েছে, দল গঠনে ভুল আছে, সেগুলো নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠুক। কিন্তু সেই সঙ্গে এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠুক, সৌরভ গাঙ্গুলি যে স্বপ্নের বীজটা রোপন করেছিলেন সেই গাছটা আজ কোথায়? লক্ষ্মণ, রণদেব, ওয়াকার, মুরলিধরনদের জায়গায় কারা এলেন? ভিশন-২০২০-এর পরবর্তী ক্যাম্প কবে? কোথায়? একটা ফাইনালে টস হার হয়েছে, ভুল দলগঠন হয়েছে, কিন্তু ওইরকম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত প্রজেক্ট না থাকলে যে আবার সেই দশ বছরে একবার ফাইনালে উঠবো। আর থাকলে কাপ আর ঠোঁটের দূরত্ব ঘুচবেই এবং সেই সঙ্গে কাটবে এই হতাশার পর্বও।