শুনতে অদ্ভুত লাগলেও ব্যাপারটা যেন অনেকটা সেইরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নয় যে আপনি ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় যিনি ফর্ম হারিয়েছেন। কিন্তু সত্যি সেটা কি ফিরে পাওয়ার নূন্যতম চেষ্টা আপনার মধ্যে আছে? বাইরে থেকে দেখে তো মনে হচ্ছে না।
এখনও অবধি আপনার আন্তর্জাতিক কেরিয়ারকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাঙা যায়, কোভিড-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী। কোভিড-পূর্ববর্তী অর্থাৎ ভারতের নিউজিল্যান্ড সফর পর্যন্ত আপনার ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন আপনার অতি বড় সমালোচকও তুলতে পারবে না। কিন্তু তারপর?
আর এটা দেখেই খুব স্বাভাবিক ভাবে যে প্রশ্নটা প্রথম উঠে আসে সেটা হল কোভিডের কারণে ঘটা একটা লম্বা বিরতিই কি ব্যাটার বিরাটের ছন্দপতন ঘটালো? সেটা কিন্তু একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, হয়তো অনেকের ক্ষেত্রেই এটা হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
এই সময়টায় যে ব্যাপারটা ভীষন ভাবে লক্ষ্যণীয়, যে ক্রিকেটার সবসময় খেলতে চাইতেন, কেরিয়ারের শুরু থেকে হয়তো হাতে-গোনা কয়েকটা ম্যাচ বিশ্রাম নিয়েছেন, তিনিই এখন কারণে অকারণে বিশ্রামে গেছেন এবং যেতে চাইছেন। যদি কোভিডের কারণে ক্রিকেট বন্ধ হওয়াটা তাঁর স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে, তবে এতে যে আরও ক্ষতি হচ্ছে সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? আর সমস্যা যদি টেকনিক্যাল হয়ে থাকে তবে সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সেই সমস্যার সমাধান হবে না। তার জন্য বাড়তি প্র্যাকটিস সেশন দরকার, দরকার পরের পর যেকোন ম্যাচ খেলে যাওয়ার। কিন্তু বিরাট আপনি ভারতের হয়ে টানা তিনটে সিরিজ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শেষ কবে খেলেছেন বলতে হ’লে আপনাকে ভাবতে হবে। লক্ষ্যণীয় ভাবে কোভিডের পর থেকে আপনার এই প্রবণতা যত বেড়েছে, ফর্মও তত খারাপ হতে থেকেছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে এই বায়ো-বাবল, টানা ক্রিকেট, বয়সের উর্ধমুখী গ্রাফ কোথাও একটা মানসিক ক্লান্তি আনতেই পারে। তার জন্য ক্রিকেট থেকে কিছুদিন দূরে থাকাটা সবচেয়ে ভাল ওষুধ হতেই পারে। কিন্তু সেটার সমাধান বোধহয় এটা নয় যে, একটা সিরিজ খেলব তো একটা খেলব না, হঠাৎ হঠাৎ করে বোর্ডের কাছে ছুটির আবেদন করব। সত্যি যদি মানসিক সমস্যা বা ক্রিকেটের জন্য মানসিক অবসাদ এসে থাকে তাহলে লম্বা ছুটি নিন। ন্যূনতম তিন বা ছয় মাসের। তরতাজা হয়ে ফিরে আসুন। যেমন সম্প্রতি বেন স্টোকস করলেন। কিন্তু এই ইচ্ছেমতো একটা সিরিজ খেলব আর একটা খেলব না পন্থায় যেমন নিজের ব্যাটিংয়ের ক্ষতি হচ্ছে, আসল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না তেমন দলেরও ক্ষতি হচ্ছে। আপনার মতো সিনিয়র ক্রিকেটারের এটা বোঝা উচিত।
আর যদি সমস্যা টেকনিক্যাল হয়? সেক্ষেত্রে বিশ্রাম নয়, মাঠে আরও আরও বেশি করে সময় কাটানোই যে একমাত্র রাস্তা সেটা গাভাসকারের মতো মানুষরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন। কিন্তু যেহেতু ভদ্রলোকের নাম সুনীল গাভাসকার, আপনি তাঁর পরামর্শ শুনবেন বলে মনে হয় না। সে নাই বা শুনতে পারেন। কিন্তু শচীন তেন্ডুলকর কী দোষ করলেন? একই শহরে থাকেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কী ফোন করে মাঠে এই প্রাক্তন সতীর্থকে ডেকে এনে টেকনিক্যাল কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটা দেখিয়ে নেওয়া যেত না বিরাট? তর্কের খাতিরে তাঁকেও বাদ দিলাম। আপনার ড্রেসিংরুমেই কোচের চেয়ার অলঙ্কৃত করে বসে আছেন ভারতীয় ক্রিকেটের গত পঞ্চাশ বছরের টেকনিক্যালি সবথেকে তুখোড় ব্যাটারদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। তাঁর সঙ্গে এখনও অবধি কোন বিশেষ নেট সেশন? আপনার আগের প্রজন্মের প্রতিটা ব্যাটার কিন্তু যখনই কোন সমস্যায় পড়েছেন তখনই প্রাক্তন ক্রিকেটারদের শরণাপন্ন হয়েছেন, পাগলের মতো নিজের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আপনি এগুলো করবেন না। কারণ? ইগো। এক অদ্ভুত ইগো, অহমিকা আপনাকে ঘিরে রেখে দিয়েছে যা আপনাকে দিয়ে এগুলোর কোন কিছুই করতে দিচ্ছে না। আপনার বোর্ড প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রেস কনফারেন্স করার সময় আছে কিন্তু শচীন তেন্ডুলকরকে ওয়াংখেড়ের নেটে দুদিন ডেকে নেওয়ার মতো সময় বা ইচ্ছে নেই। মনে পড়ে ২০১৪-র ইংল্যান্ড সফরের ব্যর্থতার কথা? তারপর এই মানুষটার একটা ছোট্ট উপদেশই কিন্তু আপনাকে রানের বন্যায় ফিরিয়ে এনেছিল। যান, আর একবার অন্তত তাঁর কাছে ফিরে যান! কথা বলুন, প্রয়োজনে নেটে ডাকুন।
বিরাট, আপনি মহান ব্যাটার। ইতিমধ্যেই যা কীর্তি স্থাপন করেছেন, তাতে ক্রিকেট দুনিয়া এমনিই আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে। তার জন্য আর একটা বাড়তি রানও করার প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু সেটা কি আপনার প্রতিভা, ক্ষমতার সঠিক ছবিটা তুলে ধরবে? আপনার অগণিত সমর্থকরা বসে ছিল আপনার একশো শতরান দেখবে বলে, যেটা একটু একটু করে মরীচিকায় পরিণত হচ্ছে। আপনার নিজের ভুলে।
আসলে বিষয়টা কি জানেন বিরাট? একশো শতরান যে মানুষটা করেছেন তিনি চব্বিশ বছর ধরে শুধু ক্রিকেটটাই খেলে গেছেন। বাহ্যিক কোন বিষয়ে মাথা ঘামাননি, শুধু ক্রিকেট-সাধনা ছাড়া। অযথা কারও বিরুদ্ধে মুখ খুলে, অযাচিতভাবে কোন বিতর্কে ঢুকে নিজের ফোকাস নষ্ট করেননি। সমস্ত কিছুর জবাব ব্যাটের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন, বছরে দশটা শতরান করলেও অহংকার, ইগো নামক ভয়ংকর বাউন্সারগুলোকে নিজের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি। মোদ্দা কথা এই মহান খেলাটাকে কখনও কোন কিছুর থেকে আগে রাখেননি, সারাজীবন একনিষ্ঠ ভক্তের মতো খেলাটাকে একপ্রকার পুজো করে এসেছেন।
বিতর্ক, ইগো, মাঠের বাইরের সমস্ত অঙ্ককে ভুলে গিয়ে খেলায় ফিরুন বিরাট। ২০১১-র ২রা এপ্রিল রাতে শচীনকে কাঁধে তুলে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণের বিষয়ে নিজের করা মন্তব্যটা মনে আছে আপনার? থাকলে ওই মানসিকতাকে ফিরিয়ে আনুন বিরাট, দেখবেন রান আপনার ব্যাটে আবার বশ্যতা মেনেছে। ওই ‘বিরাট’ পারে একশো শতরান করতে। ফিরিয়ে আনুন সেই বিরাটকে যিনি ২০১৮-র ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন, যিনি যে কোন মূল্যে রান করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, রান করার অদম্য ইচ্ছে যাঁর শরীরী ভাষায় প্রতিমুহূর্তে ফুটে উঠছিল। এটা একমাত্র আপনিই করতে পারেন। আর এটা করতেই হবে আপনাকে। শুধু আপনার জন্য নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য, আপনার অগণিত ভক্তের জন্য।