আজ “ভ্যালেন্টাইন্স ডে”, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মা্ধ্যমের কল্যাণে আমরা প্রায় সবাই সেটা জানি। তাই হঠাৎ মনে হ’ল এই দুই ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে একটু চর্চা করা যাক। নামের পদবী ছাড়াও এই দুজনের মধ্যে একটা বড় ক্রিকেটীয় মিল আছে। কি সেই মিল? দেখা যাক।
বলুন তো টেস্ট ক্রিকেটে কোনও ম্যাচে খুব উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত সাফল্যের পরিচায়ক কি? অনেকেই ঠিক ধরেছেন – ব্যাটারের ক্ষেত্রে সেঞ্চুরি আর বোলারের ক্ষেত্রে ফাইফার, অর্থাৎ ব্যাটিংয়ে ইনিংসে একশ বা তার বেশি রান করা আর বোলিংয়ে ইনিংসে পাঁচটা বা তার বেশিসংখ্যক উইকেট নেওয়া। তার ওপর কোনও ক্রিকেটার যদি তাঁর অভিষেক টেস্টম্যাচে এমন কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এমনটাই করেছিলেন এই দুই ভ্যালেন্টাইন – ব্যাটিংয়ে ব্রায়ান এবং বোলিংয়ে অ্যালফ্রেড। শোনা যাক সেই দুই ‘প্রেম’-কাহিনী!
ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইন
কেম্ব্রিজের ফুটবল ও ক্রিকেট ব্লু ব্রায়ান হারবার্ট ভ্যালেন্টাইন [১৭ই জানুয়ারি, ১৯০৮ – ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩] ইংল্যান্ডে কেন্ট দলের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ১৯২৭ সালে, তবে ১৯৩১ সালের আগে দলে নিয়মিত হয়ে ওঠেননি। হাতে সুন্দর মার ছিল, প্রধানত লেগের দিকে, বিশেষ করে অন-ড্রাইভ, তবে রক্ষণে কিছু দুর্বলতা ছিল। দ্রুত রান তুলতে পারতেন, ঘন্টায় গড়ে ৫০-এর আশেপাশে। কিন্তু তখন ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ব্যাটিংয়ের কারণে টেস্ট দলে খেলার সুযোগ পান মাত্র সাতবার, দু’বার ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৩৩-৩৪ সফরে ও পাঁচবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৯৩৮-৩৯ সফরে।
ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট-সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বও এঁরই। ১৯৩৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বম্বের জিমখানা মাঠে সিরিজের প্রথম টেস্টে, যেটা তাঁর নিজের অভিষেক টেস্টও বটে, তিনি এই শতরান করেন – আউট হন বাঁ-হাতি স্পিনার জামশেদজীর বলে বিজয় মার্চেন্টের হাতে ধরা পড়ে, (১২টা চার ও একটা ছয় সমেত) ১৩৬ রান করে। উইকেটে যখন আসেন তখন ইংল্যান্ড ১৬৪-৪, অধিনায়ক জার্ডিনের সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে ১৪৫ রানের জুটি করেন, যখন আউট হন তখন দলের রান ৩৭১-৭ – অর্থাৎ তিন ঘন্টায় ওঠা ২০৭ রানের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ তাঁরই। বিপক্ষে বোলার ছিলেন মহম্মদ নিসার, অমর সিং, লাঢা রামজী, রুস্তমজি জামশেদজী, সিকে নাইডু ও লালা অমরনাথ।
ভারতের মাটিতে টেস্ট-ম্যাচে স্টাম্পড হওয়া প্রথম বিদেশী ব্যাটারও তিনি। এটা হয়েছিল ক’লকাতার ইডেন গার্ডেন্সে সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে, ব্যক্তিগত ৩ রানের মাথায় তাঁকে স্টাম্পিং করেন উইকেটরক্ষক দিলাওয়ার হুসেন, নাওমল জিওমলের লেগব্রেক বলে – ঐ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ব্রায়ান করেছিলেন ৪০ রান।
সীমিত টেস্ট-জীবনে তিনি মোট রান করেন ৪৫৪, গড় ৬৪.৮৫, দুটো সেঞ্চুরি ও একটা ৯৭ – অতএব বলাই যায় স্বল্প সুযোগের সদ্ব্যবহার ভালই করেছিলেন। কেপ টাউন টেস্টে ১৬০ মিনিটে ১১২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে আহত হওয়ার পরেও যুদ্ধশেষে আরো কিছুদিন কেন্টের অধিনায়ক হিসেবে কাউন্টি ক্রিকেট খেলে ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।
অ্যালফ্রেড ভ্যালেন্টাইন
জ্যামাইকার কিংস্টনে ১৯৩০ সালের ২৮শে এপ্রিল তাঁর জন্ম – আর ১৯৫০ সালের ইংল্যান্ড সফরে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ক্রিকেট-বিশ্বকে চমকে দেন বাঁ-হাতি এই স্পিনার। আজও যেকোনও ক্রিকেট-প্রেমী মনে করতে পারেন লর্ড কিচেনারের সেই বিখ্যাত ক্যালিপ্সোর কলি: “Those two lilltle pals of mine, Ramadhin and Valentine” – হ্যাঁ, ইনিই সেই প্রথম ক্যারিবিয়ান স্পিন-যমজের বাঁ-হাত।
সেই ইংল্যান্ড সফরের আগে দলগঠনের দুটো ট্রায়াল ম্যাচ ছাড়া অন্য কোন প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ অ্যালফ খেলেননি এবং সেখানেও মাত্র দুটো উইকেট পান, ১৯০ রান দিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলে জায়গা হয়। আর সেই টেস্ট-সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩-১ ম্যাচে সিরিজ জয়ের অন্যতম কারিগর হয়ে ওঠেন অ্যালফ যাঁর পরিচিতি হয়ে যায় ‘ভ্যাল’ নামে।
রোগা, লম্বাটে গড়নের ভ্যাল চাকা-ঘোরানো ভঙ্গিমায় একটু দ্রুতগতিতে বল করতেন আর অনেকখানি বল ঘোরাতেন। তাঁর দলের কেউ কেউ বলতেন যে তিনি নাকি টেবিলের কাচের ওপরেও বল ঘোরাতে পারতেন। সেই সফরে তিনি প্রায় ১২০০ ওভার বল করে মোট ১২৩টা উইকেট দখল করেন, গড় ১৭.৯৪, ওভারপ্রতি গড়ে দুইয়েরও কম রান দেন – আঙ্গুলে ফোস্কা পড়ে ক্ষত হয়ে গেছিল, নিয়মিত ওষুধ লাগাতেন।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে সিরিজের প্রথম টেস্টে, যেটা তাঁর নিজের অভিষেক টেস্টও বটে, তাঁর বোলিং ছিল ৫০-১৪-১০৪-৮ ও ৫৬-২২-১০০-৩ – প্রথম ইনিংসে ইংল্যন্ডের প্রথম আটটা উইকেটের সবকটাই তাঁর, লেন হাটন, রেগ সিম্পসন, বিল এডরিচ, ট্রেভর বেইলি, গডফ্রে ইভান্স সমেত – তবে ব্যাটিং ব্যর্থতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে হেরে যায়। তবে পরের তিনটে টেস্টেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতে আর চার ম্যাচের ঐ সিরিজে তিনি ওভারপ্রতি ১.৫৯ রান দিয়ে ৩৩টা উইকেট দখল করেন, গড় ২০.৪২ – অসাধারণ বলতেই হয়।
টেস্ট-জীবনে ১২ বছরে ৩৬টা টেস্ট খেলে তিনি মোট ১৩৯টা উইকেট দখল করেন, গড় ৩০.৩২, ওভারপ্রতি ১.৯৫ রান দিয়ে, ফাইফার আছে আটটা, ম্যচে দশ বা তার বেশি উইকেট দু’বার, দুটোই তাঁর প্রথম সিরিজে। ১৯৬৪-৬৫ মরশুমের শেষে তিনি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, অবশ্য তার আগেই ১৯৬২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে নিজের ঘরের মাঠ সাবিনা পার্কে তাঁর শেষ টেস্ট খেলা।
পরবর্তী জীবনে, ১৯৭৮ সাল থেকে, অ্যামেরিকার ফ্লোরিডায় থাকতেন, সেখানেই ২০০৪ সালের ১১ই মে মারা যান।