গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ১৯৬৯-এ, কানপুর গ্রীনপার্কে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐ ম্যাচে কুড়ি পেরনো তরুণ বিশ্বনাথ প্রথম ইনিংসে আউট হয়েছিলে শূন্য রানে। প্রায় অশ্রুরুদ্ধ চোখে প্যাভিলিয়নে ফেরার সময় রানার প্রান্তে ছিলেন অধিনায়ক পাতৌদি। তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে ভেঙ্গে পড়ার মত কিছু হয়নি। তখনো তার হাতে আছে ২য় ইনিংস। এতে অবশ্যই মনের জোর বেড়েছিল বিশ্বনাথের। ২য় ইনিংসে ম্যাকেঞ্জি-কনোলি-গ্লিসন-ম্যালেট সমৃদ্ধ অস্ট্রেলীয় বোলিংকে রীতিমত নাকানিচোবানি খাইয়ে ২৫টি ঝকঝকে বাউন্ডারি সমেত তিনি করেন ১৩৭ রান। এটি ছিল তার টেস্ট আবির্ভাবেই শতরান, ৬ষ্ঠ ভারতীয় হিসবে। তার আগে এই কৃতিত্ব ছিল লালা অমরনাথ (মুম্বাই ১৯৩৩), দীপক সোধন (কলকাতা ১৯৫২), এ জি কৃপাল সিং (হায়দ্রাবাদ ১৯৫৫), আব্বাস আলি বেগ (ম্যাঞ্চেস্টার ১৯৫৯) এবং হনুমন্ত সিংয়ের (দিল্লী ১৯৬৪)।
এই শিল্পী ব্যাটসম্যান মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন দর্শকদের, এমনকি বোলারদেরও। রেকর্ড টেকর্ড হয়ে যেত আপনা আপনি এবং তারাও মুগ্ধ হয়ে গার্ড অফ অনার দিত ভিশিকে। তা এহেন বিশ্বনাথ, যার ব্যাটিংয়ের সময় ভারতে ঘড়ির কাঁটাও স্তব্ধ হয়ে যেত তার “শিল্প” দেখতে, তাকে আজও খুব “মিস” করে বিশ্বের আপামর ক্রিকেটপ্রেমী।
এ হেন গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথকেও অন্ততঃ দু’বার চরম অপমানিত হতে হয়েছিল। প্রথমবার এটা করেছিলেন ভারতীয় “ক্রিকেটপ্রেমী”-রা ১৯৮৩ সালে আর দ্বিতীয়বার এই অপমানকারী খলনায়ক ছিলেন বিসিসিআই কর্তারা, ২০১৬ সালে।
১) ১৯৮৩র জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ। সাহার বিমানবন্দর, বোম্বাই (মুম্বাই তখনো কালের গর্ভে)। সদ্য জেতা প্রুডেনশিয়াল কাপ নিয়ে ঘরে ফিরছে ভারত। উপচে পড়া লোক অ্যারাইভাল লাউঞ্জে। টিমের খেলোয়াড়দের জিনিসপত্র পরে বেরোবে, এটাই তখন দস্তুর ছিল। সুরক্ষিত এলাকার বাইরে জিনিসপত্র ছাড়াই টিম আসা মাত্র পাগল হয়ে গেল জনতা। প্রায় “স্ট্যাম্পিড” পরিস্থিতি। এ ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে, পায়ের উপর দিয়ে, যেভাবে হোক পৌঁছতে চাইছিলেন কপিল-সানি-মহিন্দার-শ্রীকান্ত-সন্দীপ-যশপাল-কীর্তি-কিরমানি-মদনলাল-বিনি-বলবিন্দার-বেঙ্গসরকার-শাস্ত্রী-ওয়ালসনদের কাছে।
এইভাবেই সামনে থাকা একটি গুডস ট্রলির উপরেও উঠে পড়েন কেউ কেউ। যিনি ট্রলিটা ঠেলে নিয়ে আসছিলেন, তিনি গেলেন ছিটকে পড়ে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দী করেন “আজকাল”-এর আলোকচিত্রী শিবশঙ্কর কাঞ্জিলাল (শিবুদা)। আজকের দিন হলে অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হত ঐ ছবিগুলি। ওরই মধ্যে একটি ছবি নিয়ে পরদিন “আজকাল”-এ অশোক দাশগুপ্ত লিখেছিলেন এক চোখে জল আনা লেখা, “এই হল ভারতবর্ষ” শিরোনামে।
কেন? কেননা, সেই ছিটকে পড়ে যাওয়া বছর ৩৪-এর ভদ্রলোকও (যিনি গত ১২ ফেব্রুয়ারি ৭৩ বছরের বাউন্ডারি পেরেয়ে এলেন) একটু আধটু ক্রিকেট খেলে (১৪ বছর ধরে, ১৯৬৯ – ১৯৮৩) তার মাস কয়েক আগে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। ৯১ টেস্টে ১৫৫ ইনিংসে ১৪টি শতক আর ৩৫টি অর্ধশতক সহ ৬,০৮০ রান ছিল তাঁর। এছাড়াও ২৫টি একদিনের ম্যাচে ২৩ ইনিংসে ২টি অর্ধশতক সহ ৪৩৯ রান করেছিলেন তিনি। এবং বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকার হিসেবে ইংল্যান্ডে ঐ প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপের মাঠেই হাজির ছিলেন।
বিশ্বকাপ জিতে ফেরা নায়কদের দেখতে মুম্বাই বিমানবন্দরে জনতা তার ট্রলির উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন। অবসৃত তিনিও ঐ কপিল-সানি-জিমি সহ নায়কদের সঙ্গেই ফিরছিলেন সেদিন ইংল্যান্ড থেকে। ভদ্রলোকের নাম? গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ। ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা শিল্পী ব্যাটসম্যান মানা হয় যাঁকে, আজও। ঘটনাটা প্রমাণ করেছিল, আমজনতার স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি অতীতকে স্বীকৃতি দেয়না। পুজো পান বিজয়ীরাই, দ্বিতীয় বলে কিছু হয়না। এবং এটা আজও দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঐতিহাসিকভাবেই।
২) আর ১৯৮৩র প্রায় ৩৩ বছর পরে ঐ কানপুরের মাঠেই ৫০০ তম টেস্ট খেলেছিল ভারত ২০১৬-র ২২ সেপ্টেম্বর থেকে। বিসিসিআই কর্তারা আগমার্কা থেকে দাগমার্কা, প্রায় সব প্রাক্তন অধিনায়ককেই এই উপলক্ষে ডেকে উঠতে পারলেও ডাক পাননি বিশ্বনাথ। কৈশোরের প্রথম ক্রিকেট ভালবাসাকে দ্বিতীয়বার অপমানিত হতে দেখে তীব্র ক্ষোভে পুড়ে গিয়েছিলাম সেদিন।
কারণ তাঁকে দেখেই আমার ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। বিশ্বনাথকে দেখেই ক্রমশ বুঝতে পারা যে স্কোরবোর্ড নিছকই একটা ফর্ম্যালিটি। ভিশিকে দেখেই উপলব্ধি করেছিলাম যে ক্রিকেটে নন্দনতত্ত্বটাই দর্শক মনোরঞ্জনের চালিকাশক্তি, যার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত মাঠে টাঙ্গানো বিশাল কালো বোর্ডটা। ভিশিকে দেখেই বিশ্বাস জন্মেছিল যে অফ-স্টাম্পের বাইরের বলও কবজির মোচড়ে চোখের পলকে পৌঁছে দেওয়া যায় স্ক্যোয়ার-লেগ বাউন্ডারির বাইরে। ভিশিকে দেখেই বিস্ফারিত চোখে প্রশান্তির পরশ লাগত এই ভেবে যে স্ক্যোয়ার-কাট আর কভার-ড্রাইভও ছদ্মবেশ ধরে ঘড়িকে হার মানানো টাইমিংয়ের ভালবাসা হয়ে যেতে পারে।
ভিশিকে দেখেই জেনেছিলাম যে ক্রিকেটের প্রতিশব্দ হতে পারে শিল্প।