“চায়নাম্যান” বোলিংয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও এলিস আচং

সম্প্রতি কুলদীপ যাদব বেশ কয়েকমাস পরে সাদা-বলের ভারতীয় একাদশে স্থান পেয়ে খেললেন। উনি একজন বাঁ-হাতি লেগ-স্পিন বোলার যাঁদের অনেকে “চায়নাম্যান” বোলারও বলেন। কিন্তু চীনদেশে তো ক্রিকেটের প্রচলন ছিলনা [যদিও চীন ২০০৪ থেকে ICC-র অধিভুক্ত (affiliate) সদস্য এবং ২০১৭ থেকে সহযোগী (associate) সদস্য হয়েছে।], তাহলে বিশেষ একধরণের বোলিংয়ের নাম কেমন করে এমন হয়েছে? গল্পটা জানতে গেলে একবার যেতে হবে ১৯৩৩ সালের ২৪শে জুলাই ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড মাঠে।

এলিস আচং ছবি: গুগল

টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসের ৩৭৫ রানের জবাব দিতে গিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা বেকায়দায় পড়া ইংল্যান্ডকে তখন অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন (১২৭) ও লেগ-স্পিনার অল-রাউন্ডার ওয়াল্টার রবিন্স (৫৫) সপ্তম উইকেটে ১৪০ রানের জুটিতে বিপক্ষের রান অতিক্রম করার দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছেন, দলের রান ৩৭৪-৬ – এমন সময় এক বাঁ-হাতি স্পিনারের অফ-স্টাম্পের বাইরের একটা বল তেড়ে মারতে গিয়ে ফস্কে স্টাম্পড হয়ে যান রবিন্স আর ঐ রানেই ইংল্যান্ডের বাকি উইকেটগুলো, জার্ডিন সমেত, পড়ে গিয়ে ইনিংস শেষ হয় ৩৭৪ রানে, এক রানে পেছিয়ে থেকে। সেই প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাঠে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকার নজির তৈরি করে।

আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে হতাশ ও বিরক্ত রবিন্স নাকি সহ-খেলোয়াড় জো হার্ডস্টাফকে বলেন, “Fancy being done by a bloody Chinaman!” – বোলারটি ছিলেন ত্রিনিদাদের খেলোয়াড় এলিস আচং – এবং এরপর থেকেই সম্ভবত ক্রিকেটে ‘চায়নাম্যান’ বোলিং কথাটা চালু হয়। কে ছিলেন এই আচং? সত্যিই কি তিনি এইজাতীয় বোলিংয়ের আবিষ্কর্তা? একঝলক দেখা যাক ইতিহাস কি বলে।

আচংয়ের জন্ম ১৯০৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি. ত্রিনিদাদের পোর্ট অফ স্পেনে। তিনিই প্রথম চীনা-বংশোদ্ভুত ক্রিকেটার যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলেন, ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে পোর্ট অফ স্পেনে, তাঁর ঘরের মাঠ কুইন্স পার্ক ওভালে। সে ম্যাচে জীবনের প্রথন ইনিংসে ৬৪ রানে দুই উইকেটই তাঁর টেস্ট-জীবনের সেরা, তৎকালীন বিখ্যাত ব্যাটার প্যাটসি হেনড্রেন তাঁর বলে বোল্ড হন – দ্বিতীয় ইনিংসে কোনও উইকেট পাননি – ঐ সিরিজে দলে আর সুযোগও পাননি।

বাঁ-হাতি এই স্পিনারটি এরপর ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ড সফরে তিনটে টেস্টেই খেলেন, তবে সিরিজে মোট পাঁচটার বেশি উইকেট পাননি – সফরে সব প্রথম-শ্রেণীর খেলায় মোট ৭১টা উইকেট নেন। এরপর আবার ১৯৩৫ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যাচে ব্রিজটাউন ও পোর্ট অফ স্পেনে খেলেন, তবে দুই ম্যাচ মিলিয়ে মাত্র একটা উইকেট পাওয়ায় দলে আর সুযোগ পাননি – তাঁর টেস্ট-জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

১৯৩৫ সালের পর থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলতেন – ত্রিনিদাদে ফিরে আসার পর ১৯৫৪ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে পোর্ট অফ স্পেনে তিনি আম্পায়ার ছিলেন।

প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩৮ ম্যাচে মোট ১১০ উইকেট দখলকারী এই খেলোয়াড়টির জীবনাবসান হয় ১৯৮৬ সালের ৩০শে অগাস্ট, পোর্ট অফ স্পেন শহরে।

পরবর্তীকালের চায়নাম্যাান বোলারদের কয়েকজন ছবি: ইন্টারনেট

বাঁ-হাতি লেগ-স্পিন বোলিংয়ের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকলেও এই ধরণের বোলিংয়ের আবিষ্কর্তা কিন্তু এলিস আচং নন – ১৯২০-র দশকের অস্ট্রেলিয়ান সংবাদপত্র ঘাঁটলে জানা যায় যে আন্তর্জাতিক স্তরে এর প্রয়োগ সম্ভবত প্রথম করেন দক্ষিণ আফ্রিকার চার্লস লিউলিন, ১৮৯৬ সালের মার্চে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জোহান্সবার্গ টেস্টে।

এছাড়া, ইংল্যান্ডের রয় কিলনার ও মরিস লেল্যান্ড, এবং অস্ট্রেলিয়ার লেসলি ফ্লিটউড-স্মিথ – এঁরাও এই ধরণের বোলিং করতেন ব’লে জানা যায়, তবে ‘চায়নাম্যান’ শব্দটার ব্যবহার সম্ভবত আচংয়ের সঙ্গেই চালু হয়।