ভারত বনাম জিম্বাবোয়ে সেদিনের ম্যাচটি ছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে গ্রুপ বি-তে ভারতের ৫ম ম্যাচ। আগের ৪ ম্যাচের মধ্যে প্রথম দুটিতে জিতে (১ম পর্বে ওঃ ইন্ডিজ আর জিম্বাবোয়ে) ও পরের দুটিতে হেরে (১ম পর্বে অস্ট্রেলিয়া ও ফিরতি ম্যাচে ওঃ ইন্ডিজ) ৮ পয়েন্টে দাঁড়ানো ভারতকে সেমিফাইনালে যেতে হলে বাকি ২টি ম্যাচে (ফিরতি ম্যাচে জিম্বাবোয়ে ও অস্ট্রেলিয়া) জিততেই হত। অন্যথায় প্রতিযোগিতা থেকে নিশ্চিত বিদায়ের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছিল অনিবার্য। এই পশ্চাৎপটে ভারত বনাম জিম্বাবোয়ে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক শনিবার, ১৯৮৩ সালের ১৮ জুন তারিখে, আজ যার ৩৯ বছর পূর্ণ হলো।
তার অনেক বছর পরে সুনীল গাভাসকার নামে ভারতের হয়ে “কিছুটা ক্রিকেট খেলা ও বোঝা” এক ভদ্রলোক সেদিন খেলা একটি ইনিংস নিয়ে বলেছিলেন “এর চেয়ে উত্তেজক, দায়িত্বশীল এবং রোমাঞ্চকর একদিন-এর ইনিংস আমি কখনো দেখিনি”, যে ইনিংসকে “উইজডেন” মেনে নিয়েছিল সর্বকালের সেরা পাঁচ ওডিআই ইনিংসের অন্যতম হিসাবে। দুঃখের বিষয়, সেদিনের ওই অলৌকিক ইনিংস কোনও ভিডিওতে ধরা নেই। এমনকি, টানব্রিজ ওয়েলসের নেভিল গ্রাউন্ডের সাজঘরে ওই অলৌকিক ইনিংসের কোন স্থিরচিত্রও নেই। ওই ইনিংসের একটি ছক্কা মাঠ থেকে প্রায় ৯০ মিটার দূরের (বাউন্ডারির সীমানা ছিল ৬০-৬৫ মিটার) একটি বাড়ির ছাদের টালি ভেঙ্গে দিয়েছিল। জেফ্রি রিচার্ডস নামে এক ভদ্রলোক টানব্রিজ ওয়েলসে বেড়াতে যাওয়া ভারতীয় ভ্রমণকারীদের আজও সযত্নে দেখান তাঁর বাড়ির কোন্ টালিটা ভেঙে গিয়েছিল সেদিন কপিলদেবের সেই অলৌকিক ছক্কায় – “One of those sixes hit the roof of our building. He was a strong lad that Kapil Dev fellow, wasn’t he!” – এটা এখনো এক চাক্ষুষ প্রামাণ্য দলিল, ওই ইনিংসের। ঐ ভাঙ্গা টালিটা নাকি বাড়িটার মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল – “We bought this house after 1983. When the original owner was selling it off, one of his calling cards was Kapil Dev’s six hitting the roof of this house. He was proud about it,” Richards started laughing. – মজার ব্যাপার, তাই না!
ইনিংসটি যিনি খেলেছিলেন, সেই বেচারা ভারতীয় অধিনায়ক কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ সেদিন মাঠে নামার আগে সময়াভাবে ভালো করে স্নানটুকুও করে উঠতে পারেন নি। কোন কিছু ভাবার সময়ও সেদিন কেউ তাকে দেননি। কারণ, ভারতের ৪ উইকেটে ৯ রান, এমন এক অবস্থায় তাঁকে মাঠে নামতে হয়েছিল খুব তাড়াহুড়ো করে। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের সম্ভাবনার কালো মেঘ তখন ছেয়ে ফেলছিল ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশ। টসে জিতে ব্যাট নিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক আর আউট হয়ে গিয়েছিলেন সুনীল গাভাসকার (০), কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত (০), মহিন্দার অমরনাথ (৫) ও সন্দীপ পাতিল (১), আর ভারতীয় অধিনায়ক মাঠে নামার একটু পরেই যশপাল শর্মা (৯) আউট হন এবং ভারত হয়ে গিয়েছিল ৫ উইকেটে ১৭। তারপরে ষষ্ঠ উইকেটে ৬০ রান যোগ হওয়ার পরে নিজের ২২ রানে আউট হন রজার বিনি, দলের রান তখন ৬ উইকেটে ৭৭। এবং তারপরেই রবি শাস্ত্রী (১) আউট হয়ে যাবার ফলে ভারত হয়ে যায় ৭ উইকেটে ৭৮।
লাঞ্চ যখন হলো, ভারত তখন ৩৫ ওভারে ৭ উইকেটে ১০৬-এ দাঁড়িয়ে, অধিনায়কের সঙ্গে তখন অপরাজিত মদনলাল শর্মা প্যাভিলিয়নে ফিরলেন। একটা চেয়ারে লাঞ্চের জন্য এক গ্লাস জল চাপা দেওয়া ছিল, উল্টোদিকে ছিল আর একটি খালি চেয়ার। সেখানে সেদিন তার একজনও টিমমেট ছিলেন না। অধিনায়কের কাছে হেনস্থা হওয়ার ভয়ে বিদ্ধ তারা সবাই জাস্ট পালিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে। ৮ম উইকেটে ৬২ রান তুলে, লাঞ্চের কিছু পরে মদনলাল (১৭) আউট হতেই ভারত পৌঁছে যায় ৮ উইকেটে ১৪০ রানে। তখন উইকেটে এসেছিলেন সৈয়দ কিরমানি।
এরপরেই ১৯৮৩র ইংল্যান্ডের প্রখর গ্রীষ্মকালকে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের বসন্তদিনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিলেন কপিলদেব নামক জিনিয়াস। তাঁর তুফানী ব্যাটের দাপটে মাঠ জুড়ে বইতে শুরু করল এক উদ্দাম ঝড়, যাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেল জিম্বাবোয়ের বোলিং। সৈয়দ কিরমানিকে অন্য প্রান্তে রেখে শুরু হল তাঁর ব্যাটের “নটরাজীয় প্রলয় নাচন”। রেকর্ড ১২৬ রান উঠল নবম উইকেটে, যার মধ্যে কপিলদেবের অবদান ছিল ১০২ রান আর সৈয়দ কিরমানি করেছিলেন অপরাজিত ২৪। এর মধ্যে শুধু একবার ব্যাটটা বদলেছিলেন নিজের শতরান পূর্ণ করা অধিনায়ক। ভারতীয় ইনিংস শেষ হয়েছিল ৬০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৬৬ রানে। ভারত অধিনায়কের স্ট্রাইক রেট ছিল (তৎকলীন) অকল্পনীয় ১২৬.৮১, তিনি অপরাজিত ছিলেন ১৩৮ বলে করা ১৭৫ রানে (৬টি ছয় আর ১৬টি চার)। সেটাই ছিল ওডিআই-তে ভারতের পক্ষে প্রথম শতরান। সেদিন দলের মোট রানের ৬৫.৭৯ শতাংশ রান একাই করেছিলেন কপিলদেব।
জিম্বাবোয়ে ৫৭ ওভারে ২৩৫ রানে অল আউট হয়ে গিয়ে ম্যাচটা হেরেছিল ৩১ রানে। মদনলাল ৩টি, বিনি ২টি এবং কপিলদেব, বলবিন্দার সিং সান্ধু ও মহিন্দার অমরনাথ নিয়েছিলেন ১টি করে উইকেট, বাকি ২টি রান-আউট। এক সপ্তাহ পরের শনিবারেই বিশ্বকাপ জেতার জ্বালানি ভারত পেয়ে গিয়েছিল ওই ১৮ জুন ১৯৮৩ তারিখের কপিলদেবের ইনিংসেই। “কপিলদেব কা জবাব নেহি” শব্দবন্ধের জন্মদিনও ছিল ওই দিনটাই।
ওই দিনটা মনে করা এক সুখস্মৃতি, আজ ৩৯ বছর পরেও।