ব্যাটে-বলে ৫ সেঞ্চুরি

সেদিন রনজি ট্রফির কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচে ঝাড়খন্ডের বিরুদ্ধে বাংলার নবম ব্যাটার আকাশদীপ যখন ১৮ বলে অপরাজিত ৫৩ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলল, তখন কিন্তু তৈরি হল এক অত্যাশ্চর্য বিশ্বরেকর্ড। একটা ইনিংসে ৯ জন ব্যাটারের ‘ফিফটি’ করার ঘটনা অন্তত প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সেই ‘প্রথম’ ঘটল। বিষয়টি শুধু বাংলা ক্রিকেটের একটা দৃঢ় চরিত্রেরই ছবি আঁকেনি, দলীয় সমর্থকদের মনে একটা ভরসার ইঙ্গিতও জুগিয়েছে। বিশ্বরেকর্ড মানে বিশ্বরেকর্ড। একটা ইনিংসে ৯ জন ব্যাটারের ৫০-প্লাস রান করার ঘটনার মধ্যে লড়াকু, দায়িত্বশীল ও ঐক্যবদ্ধ চেহারার একটা ছবি নিশ্চিভাবেই প্রকাশ পায়, যা দলীয় আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা জোরালো করে। স্কোরকার্ডটা দেখতে দেখতে একটা অবিশ্বাস্য টেস্ট ইনিংসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে সেটা জানানোর আগে বলি, ভারতের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কা যখন  ৯৫২ রানের সর্বোচ্চ স্কোরের বিশ্বরেকর্ডটা গড়েছিল, তখন শ্রীলঙ্কার পক্ষে ক’টা শতরান সংগৃহীত হয়েছিল মনে আছে? ভারতের পক্ষে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে তিন-তিনটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন নভজ্যোৎ সিং সিধু, সচিন তেন্ডুলকর এবং মহম্মদ আজহারউদ্দিন। কিন্তু পাল্টা ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কার ব্যাটাররা তুলেছিল ৯৫২/৬। মনে পড়ে এই বিশাল বিশ্বরেকর্ড পরিমাণ রান তুলতে শ্রীলঙ্কার পক্ষে কটা সেঞ্চুরি এসেছিল? খুঁজে দেখলে ৯৫২ বস্তা-ভরা রানে আসলে সেঞ্চুরি এসেছিল মাত্র তিনটি – সনথ জয়সূর্যের ৩৪০, রোশন মহানামার ২২৫ এবং অরবিন্দ ডি’সিলভার ১২৬। সেইদিন থেকেই তথ্য নাড়াচাড়ার সময় আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল একটা টেস্টে একটা দলের একটা ইনিংসে সর্বাধিক ক’টি শত রান সংগৃহীত হয়ে থাকতে পারে? সংখ্যায় ক’টি? না, “খোঁজার কোনও শেষ নাই, খোঁজার চেষ্টা বৃথা তাই” বলে হাল ছেড়ে দেওয়ার আগেই পেয়ে গেলাম সেই বাঞ্ছিত তথ্যটি।

ক্রিকেট ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা অবিশ্বাস্য তথ্য নজরে এল, যা শেয়ার না করলে গুরুত্বটা ঠিক বোঝানো যাবে না। ১৯৫৫ সালের আজকের তারিখে (১৭ জুন) জ্যামাইকা টেস্টের শেষ দিনের খেলা চলছিল অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে। সেটা ছিল সিরিজের পঞ্চম টেস্ট। টস জিতে সেই ম্যাচে প্রথম ব্যাট করতে নেমে কিথ মিলার (৬/১০৭) ও লিন্ডওয়ালের (২/৬৪) পেস-ঝটকার বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংস শেষ করে ৩৫৭ রানে, মূলত ক্লাইড ওয়ালকটের (১৫৫) অনবদ্য লড়াইয়ের দৌলতে, সঙ্গ দিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ওরেল (৬১) ও এভার্টন উইকস (৫৬)। জবাবে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটারদের মধ্যে ৫ জন – কলিন ম্যাকডোনাল্ড (১২৭), নীল হার্ভে (২০৪), কিথ মিলার (১০৯), রন আর্চার (১২৮) এবং ৮ নম্বরে নেমে রিচি বেনো (১২১) – সেঞ্চুরি হাঁকালেন। সেই ‘প্রথম’ টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে একটা ইনিংসে পাঁচ-পাঁচজন ব্যাটার নিজস্ব শত রানের পতাকা ওড়ালেন । অস্ট্রেলিয়ার রান উঠল ৭৫৮/৮।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংসেও লিন্ডওয়াল-মিলার বেনো-জনসনের পেস-স্পিনের মিলিত আক্রমণে শেষ হয়ে গেল ৩১৯ রানে। এবং আশ্চর্য, দ্বিতীয় দফাতেও সেই ওয়ালকট (১১০) আর কিছুটা সোবার্স (৬৪) ছাড়া বিশেষ কেউই প্রতিরোধ গড়তে না পারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে যায় ইনিংস ও ৮২ রানে । এবং সিরিজ খোয়ায় ০-৩ মার্জিনে। ঘটনাটা অবশ্য ঠিক এখানেই শেষ করা গেল না। কারণ, শুধু ব্যাটিং নয়, কিংস্টন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটাররা যেখানে ৫ টি করে সেঞ্চুরি বানিয়ে দলকে এগিয়ে দিলেন, পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫ জন বোলার – টম ডিউডনি (১/১১৫), ফ্র্যাঙ্ক কিং (২/১২৬), ডেনিস অ্যাটকিন্সন (১/১৩২), কোলি স্মিথ (২/১৪৫), ফ্র্যাঙ্ক ওরেল (১/১১৬) – প্রত্যেকেই বল হাতে ১০০-প্লাস রান বিলিয়ে দেন নিজেদের বোলিংয়ে। ওহো, বলতে ভুলেছি, গ্যারি সোবার্স ব্যাট হাতে দু’ইনিংসে রান করেন ৯৯ (৩৫*+৬৪) এবং বল হাতে দেন ৯৯ রান, ১টা উইকেট পান! সিরিজ জুড়ে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ক্লাইড ওয়ালকট। ওই সিরিজে একমাত্র ব্যাটার হিসাবে একই টেস্টের দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন দু’বার। সিরিজে একাই মোট ৫ টি শতরানের কৃতি্ত্ব দেখান তিনি। জানিয়ে রাখি যে ঐ বিশালাকার অজি ইনিংসের প্রথম দু’উইকেট কিন্তু পড়েছিল ৭ রানের মধ্যেই – ওপেনার লেস ফ্যাভেল (০) ও তিন-নম্বর আর্থার মোরিস (৭) চটপট বিদায় নেন!

পুনশ্চ: দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে ২০০১ সালের ৩০শে অগাস্ট বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মুলতানে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের ৫ জন ব্যাটার – সৈয়দ আনোয়ার (১০১), তৌফিক উমর (১০৪), ইনজামাম-উল-হক (১০৫ আহত-অবসৃত), মহম্মদ ইউসুফ (১০২*), আব্দুল রাজ্জাক (১১০*) – এক ইনিংসে সেঞ্চুরি করে অস্ট্রেলিয়ার ঐ রেকর্ড স্পর্শ করেন।