প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের নাম হয়ত চট করে আমাদের অনেকেরই মনে পড়বেনা। প্রায় সাড়ে-তিন হাজার বছর আগে “লাপিটা” গোষ্ঠীর মানুষরা সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এক “সামোয়ান” ভাষা ও সংস্কৃতির পরিমন্ডল। ১৮শ শতকের গোড়ার দিক থেকে সামোয়ানদের সঙ্গে ইয়োরোপিয়ানদের যোগযোগ আরম্ভ হয় নৌযাত্রা-মৎস্যশিকার-ধর্মপ্রচার-বাণিজ্য এসবের মাধ্যমে, এবং কালক্রমে অবধারিতভাবেই সেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু – প্রথমে জার্মানী (১৯০০-১৯১৪) ও পরে নিউজিল্যান্ড (১৯১৪-১৯৬২) – যার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে সামোয়ানদের স্বাধীনতার আস্বাদ মেলে ১৯৬২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে।
স্বাভাবিকভাবেই এই আড়াই শতকেরও বেশি সময় ধরে পারস্পরিক যোগাযোগের কারণে এক মিশ্র-সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও অনেক সামোয়ান-বংশোদ্ভূত মানুষই কোনও না কোন ভাবে তাঁদের মূল পরিচয় বজায় রাখার কিছুটা চেষ্টা করতেন, তাঁদের অনেকেরই নাম দেওয়া হ’ত সামোয়ান ধাঁচের।
সেই প্রথা মেনেই বোধহয় ১৯৮৪ সালের ৮ই মার্চ ওয়েলিংটনের নীল টেলরের পরিবারে জন্মানো ছেলেটির নাম দেওয়া হয় Luteru Poutoa Lote –– যদিও এই দুরুচ্চার্য নামের ভার লাঘব করতে পরবর্তীকালে খুব শীঘ্রই অন্য নামে পরিচিত হয়েছিল ছেলেটি, তার সামোয়ান-বংশোদ্ভূত মা অ্যান-এর কল্যাণে। ছোটবেলায় প্রাথমিক স্কুলের অধ্যক্ষ (ও অন্যরাও) ছেলেটির নাম প্রায়শই গুলিয়ে ফেলতেন ব’লে মা তাঁর ছেলেটির নামে ‘ছোট. সহজ ও পাশ্চাত্যঘেঁষা’ Ross যোগ করে দেন – ‘জন্ম’ নেন রস টেলর – “LRPL Taylor” নামের এই হ’ল ব্যাখ্যান।
ডান-হাতি রস টেলরের ব্যাটিং দেখে মার্টিন ক্রো-র প্রথমে মনে হয়েছিল এ এক ‘তাড়ু’ ব্যাটার। পরবর্তীকালে কিন্তু তাঁর ধারণা এতটাই পাল্টে যায় যে তিনি হয়ে ওঠেন রস-এর ক্রিকেটীয় শিক্ষক-পথপ্রদর্শক-পরামর্শদাতা – তাঁরই জবানিতে: “Ross rang me in 2006 and asked me to mentor him. That I didn’t know him at all was beside the point. The fact was he stated clearly that he wanted to score more than 17 Test centuries, set a new record for New Zealand. So, my reply was an emphatic affirmative. He paid his own way to Auckland, we met, we spoke, and we clicked.”
ক্রো-এর প্রচুর প্রভাব টেলরের ক্রিকেট-জীবনে, বিশেষ করে সেই সময়ে যখন প্রায় দু’বছর অধিনায়কত্বের পর ২০১২ সালের শেষে (জন রাইটের পরবর্তী) নতুন কোচ মাইক হেসন-এর সঙ্গে টেলরের প্রবল মতবিরোধের কারণে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম-কে অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। শ্রীলঙ্কা সফরের ঠিক শেষেই টেলর সরে দাঁড়ান এবং পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যেতে অস্বীকার করেন, যদিও (মূলত ক্রো-এর পরামর্শেই) দেশের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজে আবার দলে ফিরে আসেন, ব্যাটার হিসেবে। ২০১৩-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন-টেস্টের সিরিজে পাঁচ ইনিংসে ৪৯৫ রান ক’রে তিনি দলে তাঁর গুরুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২-ছুঁইছুঁই টেলরের অভিষেক ওডিআই দিয়ে – ২০০৬ সালের ১লা মার্চ, নেপিয়ারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে (১০ বলে) ১৫ রান করে রান-আউট দিয়ে শুরু। তবে এর দু’দিন বাদেই অকল্যান্ডে পরের ম্যাচে (২৯ বলে) ৩১; আর তারপরের ম্যাচে, ২০০৬-এর ২৮শে ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নেপিয়ারে (১৩৩ বলে) ১২৮*, এবং দেশের বাইরে প্রথম ওডিআই ম্যাচেই ২০০৭-এর ১৪ই জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হোবার্টে (৮২ বলে) ৮৪ – এই কয়েকটা ইনিংসই প্রথম সাত-আটটা ম্যাচের মধ্যেই দলে তাঁর জায়গাটা পোক্ত করে দেয়।
অভিষেক থেকে আরম্ভ ক’রে ২০২০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ পরপর ১৫ বছরে তাঁর ওডিআই ব্যাটিংয়ের বাৎসরিক গড় মাত্র একবারই ত্রিশের নিচে নেমেছিল (২০০৭-এ ২৮.৮২), তিন বছর ছিল ত্রিশের ঘরে (২০০৯-এ ৩১.৫৫, ২০১০-এ ৩৭.৫৫ ও ২০১৬-তে ৩৩.৩৩), আর বাদবাকি ১১ বারই ছিল ৪৫ বা তার বেশি। এই দেড় দশকে সাড়ে-আট হাজারেরও বেশি রান করেন ২৩০টার বেশি ম্যাচ খেলে, গড় ৪৮.৫০-র কাছাকাছি, স্ট্রাইক-রেট ৮৩.৫০-র কাছাকাছি – ২১টা শতরান ও ৫১টা অর্ধশতরান বুঝিয়ে দেয় তাঁর ধারাবাহিকতার কথা। এর মধ্যে চারটে বিশ্বকাপ (২০০৭, ২০১১, ২০১৫, ২০১৯) ও তিনটে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০৯, ২০১৩, ২০১৭) খেলেছেন – ২০১৫ ও ২০১৯ সালে পরপর দু’বার বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজিত কিউয়িদের দলে ছিলেন। শেষ দু’বছর (২০২১ ও ২০২২) মিলিয়ে অবশ্য মাত্র চারটে ওডিআই ম্যাচ খেলে মাত্র ৩৩ রান করেন, তবে ৩৭-উত্তীর্ণ তিনি তখন প্রকৃতই অস্তাচলের পথে। ওডিআই-জীবনে মোট ১৪৬টা ক্যাচও নিয়েছেন। সাধারণত চার নম্বরে ব্যাট করতে নামা (তিন ও পাঁচ নম্বরেও অল্প কয়েকবার নেমেছেন) এই মারমুখী ব্যাটারের দ্রুত রানসংগ্রহের প্রধানতম অস্ত্র ছিল পুল-শট এবং স্লগ-সুইপ।
নিউজিল্যান্ড তুলনায় টেস্ট-ক্রিকেট কমই খেলে ব’লে টেস্ট-অভিষেকের (২০০৭ সালের ৮ই নভেম্বর) জন্য ২০০৭-০৮ মরশুমের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সেদেশের উইকেটে স্টেন-এনতিনি-নেল-কালিস এঁদের বাড়তি বাউন্স সামলাতে বড়রকম অসুবিধেয় পড়েন টেলর এবং পরবর্তী সিরিজে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে দল থেকে বাদ পড়েন। সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দলে ফিরে এসে ২০০৮ সালের ৬ই মার্চ হ্যামিল্টনে ১২০ তাঁর প্রথম টেস্ট-শতরান – সেই তিন-টেস্টের সিরিজে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে করলেন ১২০, ৬, ৫৩, ৫৫, ২, ৭৪ – মোট ৩১০ রান, দলে জায়গা পাকা হ’ল। এরপর গেলেন ইংল্যান্ড সফরে – ২০০৮-এর ২৪শে মে-তে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে বিদেশে তাঁর প্রথম স্মরণীয় শতরান (১৫৪*) প্রমাণ করল যে তিনি লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। তা সেই লম্বা দৌড় চলল ২০২২ সালের ১১ই জানুয়ারি পর্যন্ত – ১১২ ম্যাচে ৭,৬৮৩ রান, গড় ৪৪.৬৬, তিনটে দ্বিশতরানসহ ১৯টা শতরান, ৩৫টা অর্ধশতরান, সর্বোচ্চ ২৯০ (বনাম অস্ট্রেলিয়া, পার্থ, নভেম্বর-২০১৫) – ১৬৩টা ক্যাচও ধরেন, প্রধানত স্লিপ-ফিল্ডার হিসেবে। শেষ টেস্টে, ক্রাইস্টচার্চে ম্যাচ শেষ করেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাঁর টেস্ট-জীবনের তৃতীয় উইকেটটা নিয়ে, দল জেতে ইনিংস ও ১১৭ রানে।
টি২০ আন্তর্জাতিকেও, ২০০৬ সালের ২২শে ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত, ১০২ ম্যাচে তাঁর পরিসংখ্যান – ১,৯০৯ রান, গড় ২৬.১৫, স্ট্রাইক-রেট ১২২.৩৭, সাতটা অর্ধশতরান আর সঙ্গে ৪৬টা ক্যাচ – নেহাৎ হেলাফেলা করবার মতন মোটেই নয়।
২০২১ সালের ২৩শে জুন সাউদাম্পটনে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে চতুর্থ ইনিংসে মূল্যবান ৪৭* রান ক’রে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের সঙ্গে জুটিতে ৯৬* রান তুলে ম্যাচ জেতানোর পর একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন: “I guess at the start of my career, there were a few ups and downs, … We had played in a few inconsistent sides, but, no, I guess over the last few years, the team has built into a fantastic consistent side and after the heartbreak of the 2019 World Cup, this is definitely the highlight and I think probably makes up for that.” দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিন ধরণের ক্রিকেটেই কিউয়ি জাতীয় দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অন্যতম এই কারিগরের অন্তত এটুকু তৃপ্তি তো অবশ্যই প্রাপ্য, তাই না! আপনারা কি বলেন?
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে, অর্থাৎ মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে, হ্যামিল্টনে নেদারল্যান্ডস-এর বিরুদ্ধে ওডিআই ম্যাচের শেষ ক্যাচটা নিয়ে দলকে ১১৫ রানে জিতিয়ে রস টেলর বিদায় নিলেন সবরকম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চ থেকে। থেকে গেল তাঁর রেকর্ডগুলো, সঙ্গে তাঁর জোরালো পুল-শট ও স্লগ-সুইপ এবং তাঁর ধরা সাড়ে-তিনশো ক্যাচের স্মৃতি।