শ্বেতাঙ্গদের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গরা, এমন অভিযোগের মামলায় শ্বেতাঙ্গরা অভিযুক্তই থেকে যান, বিচারে কি কখনও দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন?
তাই আশাতীত কিছুই হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন অধিনায়ক এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন ডিরেক্টর গ্রেম স্মিথ বেকসুর খালাস পেলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবের তিন-তিনটি অভিযোগ থেকে। ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা (সিএসএ) তাদের বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দিয়েছে, ‘উপযুক্ত প্রমাণের’ অভাবেই এই সিদ্ধান্ত। প্রশ্নটা তাই আরও বেশি করে ওঠে যে, ‘উপযুক্ত প্রমাণ’ রেখে কোনও শ্বেতাঙ্গ কি আজকের দুনিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের অবমাননা করেন?
স্মিথের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিল কৃষ্ণাঙ্গ উইকেটরক্ষক থামি তিসোলেকিলের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব প্রদর্শনের, যে-কারণে ২০১২-১৪ সিএসএ-র বাৎসরিক চুক্তিতে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে একটি টেস্টেও খেলানো হয়নি।
যা ঘটেছিল স্মিথের জবানিতে, সেই সময় এবি ডিভিলিয়ার্সকে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে রাজি করিয়েছিলেন স্মিথ। এবার, এবিডি উইকেটের পেছনে দাঁড়ালে সেই সিদ্ধান্তকে ‘দলের পক্ষে সেরা’ ধরে নিতে কোনও অসুবিধা কারও থাকার কথা নয়। সিএসএ নিযুক্ত দুই আইনজীবীরও স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়নি!
মুশকিল, তিসোলেকিল অভিযোগ করেছিলেন, যখনই সাউথ আফ্রিকার হয়ে তাঁর খেলার প্রশ্ন উঠেছে তখনই এবিডি উইকেটরক্ষণে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন বা উৎসাহী ‘করে তোলা’ হচ্ছিল! আর এই অভিযোগের সমর্থন দিচ্ছে টেস্টে এবিডি-র উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর পরিসংখ্যান। ১১৪-র মধ্যে মাত্র ২৪ টেস্টে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন ৩৬০ ডিগ্রি খ্যাত এবিডি। তার মধ্যে ২১ টেস্ট খেলেছিলেন ২০১২ থেকে ২০১৪-র মধ্যে। ক্রিকইনফো-র ( https://stats.espncricinfo.com/ci/engine/player/44936.html?class=1;filter=advanced;keeper=1;template=results;type=fielding;view=innings ) পরিসংখ্যানে পরিষ্কার, তিসোলেকিল যখন সিএসএ-র চুক্তির বাইরে চলে গিয়েছেন, এবিডি-ও ছেড়ে দিয়েছেন উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো! এমন ঘটনাগুলো শ্বেতাঙ্গ দুনিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের দমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বারবারই হয়ে এসেছে, হচ্ছে, হবেও। কিন্তু কখনও প্রমাণ করা যাবে না।
মাইকেল হোল্ডিং-এর বই ‘হোয়াই উই নীল হাউ উই রাইজ’-এ লেখা হয়েছিল, মাখায়া এনতিনি যখন ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ অথবা ডিনারে যেতেন, একা-একা খেতে বসতেন টেবিলে। কোনও শ্বেতাঙ্গ সতীর্থ তাঁকে খাওয়ার টেবিলে সঙ্গ দেননি কখনও। মনে মনে তিতিবিরক্ত এনতিনি ম্যাচের দিন হোটেল থেকে দৌড়ে দৌড়ে যেতে চাইতেন মাঠে, যেতেনও। কারণ, টিম বাসে শ্বেতাঙ্গ-সতীর্থরা তাঁর পাশ বসতেন না। প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হত, তিনি সেই দলে শ্বেতাঙ্গদের পাশে চূড়ান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। দলে তাঁকে নেওয়া হয়েছে বাধ্য হয়েই, কিন্তু তিনি সেই দলে থাকার যোগ্য নন। এবার, আপনি কী করে প্রমাণ করবেন এটা চূড়ান্ত বর্ণবৈষম্য? তাঁকে তো দলে নেওয়া হয়েছে! এনতিনি তো আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দুরন্ত সফল! তাঁর বর্ণের প্রতি বৈষম্য দেখানো হয়নি, টেস্টে ৩৯০ এবং একদিনে ২৬৬ উইকেটেই তো প্রমাণ! তাঁর সঙ্গে টেবিলে কেউ খেতে বসেননি, এ অভিযোগ কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? আর, সেটা যদি হোটেলের সিসিটিভি-তে দেখানোও যায়, তাঁর সঙ্গে বসেননি বলেই সেটা বর্ণবাদী মনোভাবের প্রতিফলন, এটাই বা আদালতে কী করে প্রমাণ করা যাবে? উল্টে, এনতিনির কথাই ধরে নেওয়া হবে তখন, তিনি নিজেই তো একসঙ্গে খেতে যেতেন না, টিমবাসেও যেতেন না!
মার্ক বাউচারকে কোচ হিসাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত, অবধারিতভাবে এক কৃষ্ণাঙ্গকে সেই পদ না-দিয়ে বা সিএসএ-র উচ্চপদস্থ কৃষ্ণাঙ্গ কর্তার কাছে রিপোর্ট দেওয়ায় অনীহা — এই সব অভিযোগই প্রমাণাভাবে খালাস। উচ্চপদস্থ কৃষ্ণাঙ্গ কর্তাদের কাছে তুলনায় নিম্নপদে থাকা কোনও শ্বেতাঙ্গর কাছে এর চেয়ে বড় সমস্যা আর কিছুই নেই। মাইকেল জনসন তো হোল্ডিংকে জানিয়ে ছিলেন, এই ‘অবমাননা’ মেনে নিতে না পেরেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু যুবক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, ‘আত্মগ্লানি’ আর ‘অবমাননা’-র চূড়ান্ত হতাশা থেকে। ‘শ্বেতাঙ্গ হয়ে আমি ওই কালো বাঁদরগুলোর অধীনে কাজ করব!’ শ্বেতাঙ্গরা যা কখনও কোনও অবস্থাতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, পারেন না!
স্মিথের বিরুদ্ধে ২৩৫ পাতার অভিযোগ উঠেছিল। আদালতে বিচার হল, ইতিহাস লিখবে, তিনি বেকসুর খালাস। খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সব মিডিয়াতেই।
কিন্তু, থেকে গেল প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে, বর্ণবাদের অবমাননা এবং অন্যান্য সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি কি আদৌ পেলেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার এবং কর্তারা?
নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে আরও একবার নীরবে নিভৃতে কাঁদল বিচারের বাণী।