“বাবরের প্রার্থনা” থেকে “বাবরের জন্য প্রার্থনা”

ক্রিকেটীয় লেখার শিরোনামে কেন শঙ্খ ঘোষের কবিতা “বাবরের প্রার্থনা”? অনেকে বলেন বটে, ক্রিকেট তো কবিতাই, ছন্দ মেলানো, অন্ত্য মেলানো, অনুভূতি মেলানো কবিতা। আবার অনেকে এর বিরোধিতাও করেন। কিন্তু এ লেখায় বিখ্যাত কবির কবিতার শিরোনাম কি যথাযথ? সাতপাঁচ ভাবনা উড়িয়ে উত্তর খুঁজতে বেরিয়ে শেষ অবধি পাল্টেই গেল এ লেখার শিরোনাম।

আসুন, এই উত্তর খুঁজে নেবার অংশীদার হতে আপাতত এক সদ্যসমাপ্ত ত্রিস্তরীয় ক্রিকেট সিরিজে ঢুকে পড়ি। অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তান, ২০২২, ৩২ দিন স্থায়ী এই ত্রিস্তরীয় ক্রিকেট সিরিজ খেলা হয়েছিল ৪ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল। যে সিরিজে  ১-০ ফলে টি২০-র এক ম্যাচের সিরিজ আর টেস্ট ম্যাচের তিন ম্যাচের সিরিজ জিতে নিলেও অস্ট্রেলিয়া হেরে গিয়েছিল ওডিআই-র তিন ম্যাচের সিরিজ, ১-২ ফলে।আমাদের আজকের আলোচনা সেই সিরিজের পাক অধিনায়ককে নিয়ে।

১)

প্রথম টেস্ট হয়েছিল রাওয়ালপিন্ডিতে, ৪-৮ মার্চ ২০২২। রাওয়ালপিন্ডিতে বহুদিন পরে এটা ছিল একটা অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। রানে ভরা ব্যাটিং পিচে পাক অধিনায়ক যখন ক্রিজে আসেন, দলের রান ছিল ২/৩১৩। তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে ৩টি বাউন্ডারিতে সাজানো ৩৬ রান করে লাবুশেনের ছোঁড়া বলে তাঁর রান আউট হবার সময়ে অবশ্য আজহার আর তাঁর জুটিতে ১০১ রান উঠে গিয়েছিল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান ডিক্লেয়ার করেছিল ৪/৪৭৬-এ, ইমামের ১৫৭ আর আজহারের ১৮৬ রানে ভর দিয়ে। জবাবে খোয়াজা, ওয়ার্নার, লাবুশেন আর স্মিথের যথাক্রমে ৯৭, ৬৮, ৯০ আর ৭৮ রানের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ৪৫৯ রান করেছিল অস্ট্রেলিয়া, নৌমান আলির ৬/১০৭ সত্ত্বেও। ২য় ইনিংসে আবার আজহারের শতরান (অপরাজিত ১১১) আর শফিকের অপরাজিত ১৩৬ ম্যাচশেষে পাকিস্তানকে ০/২৫২তে পৌঁছে দিলেও নিষ্প্রাণ ড্র হয় ওই ম্যাচ, যার ম্যাচপুরুষ হয়েছিলেন ইমাম উল হক।

১২-১৬ মার্চ ২০২২, করাচির ২য় টেস্টেও ১ম ইনিংসে ৩৬ রান করে আউট হন পাক অধিনায়ক, দলের মোট ১৪৮ রানের মধ্যে। তার আগে ৯/৫৫৬-এ ডিক্লেয়ার করেছিল অস্ট্রেলিয়া, খোয়াজার ১৬০, স্মিথের ৭২ আর ক্যারির ৯৩ রানের সৌজন্যে। ১ম ইনিংসে ৪০৮ রানে এগিয়ে থেকেও ফলো-অন না করিয়ে ২য় ইনিংসে ২/৯৭য-এ ডিক্লেয়ার করে অস্ট্রেলিয়া, জয়ের জন্য পাকিস্তানকে প্রায় ২ দিনে পাহাড়প্রমাণ ৫০৬ রান করার চ্যালেঞ্জ দিয়ে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ওই সিরিজে পাক অধিনায়কের মহাউত্থান। অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করে ফেলেছিল পাকিস্তান, ২য় ইনিংসে। প্রায় ২দিন সময় ও ১৭১.৪ ওভার হাতে পেয়েও তাদের ২য় ইনিংস শেষ করতে পারেনি প্রতিপক্ষ। ২/২১ অবস্থায় মাঠে নেমে শফিকের (৯৬) সঙ্গে ৩য় উইকেটের জুটিতে পাক অধিনায়ক করেছিলেন ২২৮ রান, আর ৫ম উইকেটের জুটিতে তিনি রিজওয়ানের (শেষ অবধি অপরাজিত ১০৪) সঙ্গে যোগ করেন ১১৫ রান। ১৯৬ রান করে পাক অধিনায়ক যখন ৫ম উইকেট হিসেবে আউট হন, তখন পাকিস্তানের রান ছিল ৫/৩৯২। দিনশেষে ৭/৪৪৩ করে এই ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেরে ভারতের প্রতিবেশী দেশ। ও হ্যাঁ, ১ম ইনিংসে ৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে বিপক্ষের উইকেটরক্ষক, ৯৩ রান করা ক্যারিকে বোল্ড আউট করে দিয়েছিলেন পাক অধিনায়ক। এ টেস্টের ম্যাচপুরুষ হয়েছিলেন পাক অধিনায়ক।

২১-২৫ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত অপেক্ষাকৃত কম স্কোরের ৩য় টেস্ট ম্যাচে জিতে ১-০ ফলাফলে সিরিজ জিতে নেয় অজিরা। এ ম্যাচে পাক অধিনায়ক করেছিলেন ৬৭ আর ৫৫ রান। প্রথমে ব্যাট করে  খোয়াজার ৯১, গ্রীনের ৭৯ আর ক্যারির ৬৭ রানের দৌলতে অজিরা করে ৩৯১ রান। শফিকের ৮১, আজহারের ৭৮ আর  পাক অধিনায়কের ৬৭ পাকিস্তানের ১ম ইনিংসকে পৌঁছে দেয় ২৬৮ রানে, কামিন্সের ৫/৫৬ সত্ত্বেও। ১২৩ রানে এগিয়ে থাকা অজিরা ৪র্থ দিনে ২য় ইনিংসে খোয়াজার অপরাজিত ১০৪ আর ওয়ার্নারের ৫১-তে ভর দিয়ে ৬০ ওভারে ৩/২২৭-এ পৌঁছে গিয়ে ডিক্লেয়ার করে দেয়।পাকিস্তানের সামনে পড়ে ছিল এক দিনের অনেকটা বেশি সময়ে ১১৭ ওভারে ৩৫১ রান করার চ্যালেঞ্জ।৪র্থ দিনের শেষে ০/৭৩-এ পৌঁছে যায় পাকিস্তান। তবু শেষ দিনে এক সময়ের ০/৭৭ থেকে ২৩৫ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। লিয়ঁর ৫/৮৩ আর কামিন্সের ৩/২৩-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পতাকা তোলা ছিল শুধু ইমামের ৭০ আর পাক অধিনায়কের ৫৫-তেই। অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স হন তাঁর দলের ১১৫ রানে জেতা এই টেস্টের ম্যাচপুরুষ। এবং টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড় হন অস্ট্রেলিয়ার উসমান খোয়াজা।

তবু ৩ ম্যাচে ৫ ইনিংসে ৭৮.০০ গড়ে ১টি শতরান আর ২টি অর্ধশতরান সমৃদ্ধ ৩৯০ রান করে ফেলা পাক অধিনায়কের (২টি ক্যাচ আর ১টি উইকেটও নিয়েছিলেন এই সিরিজে) অবদান ছাড়া এই টেস্ট সিরিজের আলোচনা হওয়া কখনোই সম্ভব না।

২)

এরপরে আসছি লাহোরে অনুষ্ঠিত ৩-ম্যাচের ওডিআই সিরিজের কথায়। ২৯ মার্চের ১ম ম্যাচে ইমামের ৯৬ বলে ১০৩ আর পাক অধিনায়কের ৭২ বলে ৫৭ সমৃদ্ধ ৪৫.২ ওভারে ২২৫ করেও ৮৮ রানে হেরে যায় পাকিস্তান দল।অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৭/৩১৩ করেছিল মূলত ট্রাভিস হেডের ৭২ বলে ১০১ ও বেন ম্যাকডার্মটের ৭০ বলে ৫৫-র কল্যাণে। ম্যাচপুরুষ হন অস্ট্রেলিয়ার ট্রাভিস হেড।

৩১ মার্চের ২য় ওডিআই ম্যাচেও প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া। ৫০ ওভারে রান ওঠে ৮/৩৪৮, হেডের ৭০ বলে ৮৯, লাবুশেনের ৪৯ বলে ৫৯ ও ম্যাকডার্মটের ১০৮ বলে ১০৪-এ ভর দিয়ে, শাহিনের ৪/৬৩ সত্ত্বেও। জবাবে ৪৯ ওভারে ৪/৩৪৯ তুলে ৬ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় পাকিস্তান, ফকরের ৬৪ বলে ৬৭, ইমামের ৯৭ বলে ১০৬ ও পাক অধিনায়কের ৮৩ বলে ১১৪ রানের সৌজন্যে। ৮৩ বলে ১১৪ রানের জন্য ম্যাচপুরুষ হন পাক অধিনায়ক, ১টি ক্যাচও ধরেছিলেন তিনি এই ম্যাচে।

৩য় ওডিআই ম্যাচেও ম্যাচপুরুষ ও সিরিজসেরা অন্য কাউকে করার উপায় রাখেন নি পাক অধিনায়ক। এ ম্যাচেও প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া। ৪১.৫ ওভারে মাত্র ২১০ রানে গুটিয়ে যায় অজিরা, ক্যারির ৬১ বলে ৫৬ রান ও অ্যাবটের ৪০ বলে ৪৯ রান সত্ত্বেও। রউফ ও ওয়াসিম নেন ৩টি করে উইকেট। জবাবে ৩৭.৫ ওভারেই ১/২১৪ রান করে ম্যাচ ও ২-১ ফলাফলে সিরিজ জিতে নেয় আয়োজক দেশ। অপরাজিত ২ ব্যাটসম্যান ছিলেন ইমাম (১০০ বলে ৮৯) আর পাক অধিনায়কের (১১৫ বলে ১০৫)।

৩ ম্যাচে ৩ ইনিংসে ১৩৮.০০ গড়ে ২টি শতরান আর ১টি অর্ধশতরান সমৃদ্ধ ২৭৬ রান করে ফেলা ছাড়াও ১টি ক্যাচ ধরা পাক অধিনায়কের অবদান ছাড়া এই ওডিআই সিরিজের আলোচনা হওয়া শুধু মুশকিলই না, অসম্ভব।

৩)

৫ এপ্রিল ২০২২ তারিখে লাহোরেই অনুষ্ঠিত একমাত্র টি২০ ম্যাচেও দুটি দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন পাক অধিনায়ক (৪৬ বলে ৬৬)। আর কেউ তেমন সহায়তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০ ওভারে ৮/১৬২ তুলে থেমে যায় পাকিস্তান। উল্টোদিকেও ফিঞ্চের ৪৫ বলে ৫৫ ছাড়া বিশেষ কোন বড় রান না থাকায় তীব্র লড়াইয়ের পরে ৫ বল বাকি থাকতে ৭/১৬৩ রান করে ৩ উইকেটে ম্যাচ জিতে ১-০ ফলে টি২০ সিরিজ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ফিঞ্চ এ ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হন পাক অধিনায়কের থেকে কম রান করেও। একমাত্র টি২০ ম্যাচে পাক অধিনায়কের রান ছিল ৬৬, ওই গড়েই।

অর্থাৎ এই অজি-পাক ত্রিস্তরীয় ক্রিকেট সিরিজে ৯টি ইনিংসে (৩৬, ৩৬, ১৯৬, ৬৭, ৫৫, ৫৭, ১১৪, অপরাজিত ১০৫ এবং ৬৬) একবার অপরাজিত থেকে মোট ৭৩২ রান করেছিলেন পাক অধিনায়ক। সার্বিক গড় দাঁড়িয়েছিল ৯১.৫০। একটি সফরে সব ফরম্যাটের ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটারের এতটা সর্বগ্রাসী আধিপত্য খুব এটা সহজলভ্য নয়, যদি তা আদৌ থেকে থাকে।

এখনো বলা হয়নি কে এই পাকিস্তানী “অলরাউন্ড অধিনায়ক”? তাঁর নাম মহম্মদ বাবর আজম। যাঁর জন্ম হয়েছিল লাহোরে, ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর তারিখে। তিনি একজন ডান-হাতের ব্যাটার, যিনি অফব্রেক বলও করেন ডানহাতেই। ২২ বছর বয়সে, তিনি ইউএই-তে ওঃ ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পরপর ৩টি ওডিআইতে শতরান করেছিলেন এবং জীবনের ৩য় টেস্টে করেছিলেন ৯০ রান। ICC Men’s Cricket World Cup Super League-এ (2020-2022/23) একটি ওডিআই সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে ১২ ম্যাচে ৫টি শতরানসহ ৯০২ রান করেছেন তিনি, যা ওই মাপকাঠিতে এখনো সর্বোচ্চ (রান) ও যুগ্ম সর্বোচ্চ (শতরান, রোহিত শর্মার সঙ্গে) রান। আপাতত পাক ক্রিকেটের তিন রকম ফরম্যাটে অধিনায়ক তিনি তাঁর অধিনায়কত্বর চাপের হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর রানের ব্যাটকে (এবং ব্যাটের রানকেও)।

আপাতত ৪০ টেস্টে ৬টি শতরান ও ২১টি অর্ধশতরান সমেত ৪৫.৯৮ গড়ে ২,৮৫১ রান, ৮৬ ওডিআইতে ১৬টি শতরান ও ১৮টি অর্ধশতরান সমেত ৫৯.১৮ গড়ে আর ৯০.২৯ স্ট্রাইক-রেটে ৪,২৬১ রান এবং ৭৪ টি২০আইতে ১টি শতরান ও ২৬টি অর্ধশতরান সমেত ৪৫.৫২ গড়ে আর ১২৯.৪৪ স্ট্রাইক-রেটে ২,৬৮৬ রান তাঁর রানের ভান্ডার অলঙ্কৃত করছে, যা অর্জিত হয়েছে বছরসাতেকের মধ্যে। তিন রকম ফরম্যাটে বিশ্বস্ত ফিল্ডার তাঁর নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা যথাক্রমে ২৬, ৪০ আর ৩৪। তাঁর আরো অনেক আগামী সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করাই যায়।

তাই “বাবরের প্রার্থনা” থেকে পাল্টে এ লেখার শিরোনাম দেওয়া যেতেই পারে “বাবরের জন্য প্রার্থনা”।