সিডনি টেস্ট ১৮৯৪

ইডেন ২০০১ এর পর ফলো-অন করানো ব্যাপারটা বচ্চন সদৃশ কান ঢাকা চুল রাখার ফ্যাশনের মতোই হারিয়ে গেছে। আসলে একটি দল যখন প্রতিপক্ষকে ফলো-অন করায়, সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, ফলো-অন খাওয়া দল তখন ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা কে দলা পাকানো কাপড়-চোপড়ের মতো আলমারিতে তুলে রাখে। মৃতপ্রায় রুগী যেমন প্রাণ বেরিয়ে যাবার আগের মিলিসেকেন্ড অব্দিও বাঁচার অবাস্তব আশা আঁকড়ে থাকে, ফলো-অন খাওয়া দলও সেরকম ওই ড্র হবার খানিক আশা জিইয়ে রাখে। কিন্তু তবুও  টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৫ বছরের ইতিহাসে তিনবার ফলো-অন খাওয়া চুল্লিতে ঢোকার বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়া দল জেগে উঠে টেস্ট ম্যাচ জিতে নিয়েছে। ইডেন ২০০১ তো বললামই। লিড্স্ ১৯৮১ টাও বহুল আলোচিত। কিন্তু এক্কেবারে প্রথমবার যখন এই কীর্তি ঘটে, সেটা নিয়ে আলোচনা প্রায় হয় না বললেই চলে। তা সেই ভুলে যাওয়া ম্যাচটা নিয়েই আজ একটু লিখতে বসলাম ওই ম্যাচের অন্যতম ট্র্যাজিক নায়ক, জর্জ গিফেন, যাঁকে অস্ট্রেলিয়রা বলতো, “গ্রেসকে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর”, তাঁর জন্মদিনে। 

এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়নি, নেতাজির জন্ম হয়নি, গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৮৯৪-৯৫। সে বছর অ্যাশেজ সিরিজ হবার কথা অস্ট্রেলিয়ায়। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব ও সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজ দল আসবে অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে। কিন্তু শুরুতেই বড়ো ধাক্কা। যাঁকে দেখতে ক্রিকেট জনতা মাঠে ভিড় জমাবে সেই ডাক্তার বাবু, উইলিয়াম গ্রেসই  তো সফরে যেতে অস্বীকার করেছেন। তা ৪৭ বছর বয়সে সাত সম্মুদুর পেরিয়ে অন্য গোলার্ধে সফর করার ধকল টাও তো কম নয়। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো, এন্ড্রু স্টোডার্টের নেতৃত্বেই ইংল্যান্ড এলো অজি সফরে। স্টোডার্ট ক্রিকেট ছাড়াও রাগবি খেলতেন। আন্তর্জাতিক স্তরে ইংরেজ অধিনায়কও হয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে সিরিজের প্রথম টেস্ট হবে সিডনিতে। তখনও জানা সম্ভব ছিলো না, ছ’দিনের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেট ও অ্যাশেজ ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা টেস্ট সিরিজের মারকাটারি সূত্রপাত দেখতে চলেছে সিডনি। অজি অধিনায়ক ব্ল্যাকহ্যাম টস জিতে ঐতিহাসিক ভাবে ব্যাটিং উপযোগী সিডনি উইকেটে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু টম রিচার্ডসনের বিক্রমে অস্ট্রেলিয়া এক সময় ২১ রানে ৩ উইকেট। দুই বড়ো ব্যাট, জো ডার্লিং ও হ্যারি ট্রট ফিরে গেছেন সাজঘরে। থাকার মধ্যে আছেন শুধু জর্জ গিফেন। 

গিফেন এবার ফ্র্যাঙ্ক ইরডেল কে নিয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করলেন। দুজনে মিলে জুড়লেন ১৭১ রান। ইরডেল ৮১ রানে ফিরে গেলেন। গিফেন তখনও খেলে যাচ্ছেন। ক্রিজে এলেন সিড গ্রেগরি। এই ম্যাচের আগে সিড গ্রেগরি খেলেছিলেন সাকুল্যে ১১টি ইনিংস। দু অংকের রান করেছিলেন মাত্র একবার। কাজেই তাঁকে নিয়ে বাজি ধরার মতো কেউ ছিলেন না। সিড গ্রেগরির বাবা ছিলেন এস.সি.জির মালি। তাঁর জন্মও সেখানে। তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্রিকেটের গন্ধ। কিন্তু এখনও অব্দি তার সৌরভ সিডনির বুভুক্ষু ক্রিকেট জনতা পেয়েছে কোথায়? গ্রেগরি এবং নিয়তি মিলে মনে হয় আঁতাত করেছিলেন, সিডনির মাঠে হওয়া অন্যতম সেরা টেস্ট ম্যাচটিতেই গ্রেগরির ব্যাটিং সৌরভের ঘ্রাণে সিডনি জনতা পাগল হয়ে যাবেন। গ্রেগরি গিফেনের সাথে জুটি বেঁধে শুরু করলেন পাল্টা মার। গিফেন ফিরে গেলেন ১৬১ করে। অস্ট্রেলিয়া দিনের শেষে ৩৪৬ রানে ৫ উইকেট। ঘরের ছেলে গ্রেগরি ৮৫ নট আউট। 

দ্বিতীয় দিনে কানায় কানায় ভর্তি এস.সি.জি গ্রেগরি জাদুতে আবার মাত হলো। গ্রেগরি শেষ করলেন ২০১ রানে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ততদিন অব্দি সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম টেস্ট ডবল সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়া শেষ করলো ৫৮৬ রানে। সিডনির জনতা চাঁদা তুলে গ্রেগরি-কে এই ইনিংসের সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ ১০৩ পাউন্ড উপহার দেয়। সিডনির প্রিমিয়ার জর্জ হাউস্টন রিড সেই টাকা গ্রেগরির হাতে তুলে দেন। ১৮৯৪-৯৫ সালে ১০৩ পাউন্ড মানে আজকের বাজারে কতো, তার একটা ছোট্ট ধারণা দিয়েছিলেন রিড তাঁর বক্তৃতায়, “এক সপ্তাহ ধরে যদি গ্রেগরির জন্যে চাঁদা তোলার বন্দোবস্ত করতাম, তাহলে ওঁর আজীবন অন্ন কষ্ট থাকতো না।” গ্রেগরি অবশ্য নিতান্তই সাদামাঠা প্রতিক্রিয়া দেন, “অনেক ধন্যবাদ” গোছের আর কি! তেমন একটা বাকচতুর ছিলেন না গ্রেগরি। তবে শুধুই ওই অনবদ্য ২০১ এর জন্যে গ্রেগরি এতো জনপ্রিয় হয়ে গেলেন ভাবলে ভুল হবে। আসলে গ্রেগরি ছিলেন, অজি জনতার কাছে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। যে ব্যাট নিয়ে তিনি খেলতেন, সেটি সিডনিতে তৈরি। অস্ট্রেলিয়ার আর কোনো খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়ায় নির্মিত ব্যাট নিয়ে খেলতেন না। তাঁদের ব্যাট আসতো ইংল্যান্ড থেকে।  

ইংল্যান্ড এরপর প্রথম ইনিংসে করে ৩২৫। অ্যালবার্ট ওয়ার্ড (৭৫) ও জনি ব্রিগস (৫৭) ছাড়া আর বিশেষ কেউই দাঁড়াতে পারেননি গিফেনের অফস্পিন কাম স্লো-মিডিয়ামের সামনে। গিফেন নেন ৪ উইকেট, ৭৫ রানে, ১৬১ রান করবার পর। এরপর ফলো-অন খেয়ে দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড খানিক ভদ্রস্থ ব্যাটিং করে। আবারও অ্যালবার্ট ওয়ার্ড ১১৭। ইংল্যান্ড যে টেস্ট ম্যাচটি জিতলো তার পিছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল ওয়ার্ডের। অথচ অন্যান্য নায়ক সহ-নায়কদের ভিড়ে ওয়ার্ডের ইনিংস দুটি থেকে গেছে ফুটনোট হিসাবেই। যেমন লিড্স্ ১৯৮১ তে গ্রাহাম ডিলির ব্যাট হাতে অবদান অনেকেই ভুলে মেরে দিয়েছেন। সেরকমই আর কি। তবে অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলার এবারও গিফেন। ৭৫ ওভার বল করে নিলেন ৪ উইকেট, ১৬৪ রানে। অস্ট্রেলিয়া ১৭৭ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নেমে পঞ্চম দিনের শেষে ১১৩ রানে ২ উইকেট। পিচ তখনও ভালো। ক্রিজে বিশ্বস্ত গিফেন ও ডার্লিং। ইংল্যান্ডের কিছু খেলোয়াড় মনের দুঃখেই কিনা কে জানে, দিনের শেষে একটু বেশিই পান করে ফেলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ইয়র্কশায়ার-এর বাঁহাতি স্পিনার ববি পিল। তাঁর রেশ পরদিন সকাল অব্দি ছিল। এমনকি মাঠে আসা পর্যন্ত। তাই আগের দিন রাতে যে বৃষ্টি হয়ে গেছে, সেদিকে আর তাঁর খেয়াল নেই। এবং ভিজে পিচে যে তিনি কি রূপে দেখা দিতে পারেন, তার আন্দাজ হারিয়ে গেছে। 

অধিনায়ক স্টোডার্ট ব্যাপারটা আন্দাজ করে পিল-কে একপ্রকার জোর করেই শাওয়ার নিতে পাঠালেন। পিল-এর নেশা কাটার পর ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্য হয়। পিল অধিনায়ককে গিয়ে বলেন, “মিস্টার স্টোডার্ট, আমাকে একবার বল দাও। ব্যাটাচ্ছেলেদের লাঞ্চের আগেই বাড়ি পাঠাচ্ছি।” তা পিল করলেনও। সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যান, চিরশত্রু ল্যাঙ্কাশায়ারের জনি ব্রিগস কে। ব্রিগস ফেরত পাঠান গিফেন-কে। আর পিল পান ডার্লিং, গ্রেগরি সমেত ৬ উইকেট। ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতে নেয় ১০ রানে। সিরিজও জেতে ইংল্যান্ড। একেবারে শেষ ম্যাচে। প্রথম দুই টেস্ট জেতার পর, তৃতীয় ও চতুর্থ টেস্টে গিফেন ও অ্যালবার্ট ট্রটের বিক্রমে জিতে নেয় অজিরা। সিডনিতে ফিরতি চতুর্থ টেস্টে তো ইংল্যান্ড ৬৫ ও ৭২ রানে অল-আউট হয়ে ইনিংসে হেরে যায়। কিন্তু মেলবোর্নে শেষ টেস্টে ২৯৮ তাড়া করে অভাবনীয়ভাবে সিরিজ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিরিজ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় থেকে গেছে ১৮৯৪-৯৫ এর অ্যাশেজ। ওই ‘মর্নিং শোজ দা ডে’-র মতো, যে সিরিজের শুরুয়াত এমন মারকাটারি হয়, তা কি কখনও মনোগ্রাহী না  হয়ে পারে?