একদম ঠিক। মেজাজটাই তো আসল রাজা। নাহলে কি আর আইপিএলের মতো হাইভোল্টেজ মঞ্চে অভিষেককারী ছেলেটা ওরকম নির্দ্বিধায় উড়িয়ে দিতে পারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একজন বিখ্যাত মিডিয়াম পেসার, স্পিনার ও পেস বোলারকে? তাও আবার কোন সময়? না যখন মহম্মদ শামির আগুনে স্পেলে ছারখার তার দল (৫ ওভার শেষে ২৯/৪)।
কিন্তু ছেলেটা নাকি বরাবর এরকমই। নাহ্ আর ভণিতা নয়, আশা করি বুঝতেই পারছেন এতক্ষণ গতরাতের আইপিএলের দুই নয়া দল লখনউ সুপার জায়ান্টস বনাম গুজারাট টাইটান্স ম্যাচে পরাজিত লখনউ দলের অন্যতম নায়ক দিল্লির আয়ুষ বাদোনির কথাই বলছি। দল পরাজিত হলেও, জিতে গেছেন যিনি। ৫ ওভার শেষে ২৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা অবস্থায় নবাবের শহরের মান বাঁচালেন দীপক হুডা কে সঙ্গী করে। হ্যাঁ শেষ অবধি দলকে হয়তো জেতাতে পারেননি কিন্তু তাতে কি এতটুকুও জৌলুস হারায় ৩ টি ছয় ও ৪ টি চার সহযোগে সাজানো ৫৪ (৪১) রানের ইনিংসটি?
শুরুতেই ঐ যে মেজাজের কথা বলছিলাম না। আসুন ফেরা যাক সেই প্রসঙ্গে। ফেরা যাক আয়ুষ বাদোনির গড়ে ওঠার প্রসqঙ্গে। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, এদেশে যখন কোনো ছেলে ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখে তখন সামনে সে কাদের রাখে? উত্তরটা খুব সোজা। কেউ চায় শচীন হতে, কেউ চায় দ্রাবিড় আবার কেউবা চায় সৌরভ হতে বা ইদানিং কালে কোহলি বা রোহিত হতে। কিন্তু বাদোনি কোনোদিনও এঁদের একজনও হয়ে উঠতে চায়নি। শুরু থেকেই সে নিজের মতন। অসাধারণ টাইমিং আর নিজস্ব স্টাইলে নিজেই নিজের তুলনা হয়ে উঠতে চেয়েছে। বাদোনির আত্মীয় মহলে খোঁজ নিলে শোনা যায় ছেলেটা নাকি একদম বেশি কথা বলেনা। এমনকি হাসে অবধি না! দিল্লির বিখ্যাত সনেট ক্রিকেট ক্লাব (বাদোনির ক্লাব) -এর প্রয়াত কোচ তারক সিনহার কথায় আপন মর্জির মালিক বাদোনি।
উত্তর দিল্লির শালিমার বাগে মধ্যবিত্ত পরিবারটির ছাদে বাদোনির ছেলেবেলার কোচ পাঞ্জাবের বলরাজ কুমারের পরামর্শে সিমেন্টের পিচ বানিয়ে দিয়েছিলেন বাদোনির বাবা বিবেক বাদোনি। বলরাজ স্যারের অনুপস্থিতিতে স্কুল থেকে ফেরার পর বাবার তত্ত্বাবধানে চলতো ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন। কিছু পাথরের টুকরো কে ফিল্ডার হিসেবে সাজিয়ে দিতেন বাবা এবং ছেলেকে বলতেন কাল্পনিক ফিল্ডার গলিয়ে গ্যাপ দিয়ে খেলতে। এভাবেই চলতো ছোট্ট বাদোনির অনুশীলন।
বলরাজ স্যারের কাছেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি বাদোনির। ছেলেবেলার কোচ থাকতেনও তাদের বাড়িতেই। তখন বছর চোদ্দো বয়স বাদোনির। অনূর্ধ্ব-১৪ লেভেলে তিনটি শতরানের পরেও অনূর্ধ্ব-১৬ লেভেলে সুযোগ না পাওয়ায় স্বভাবতই ভেঙে পড়েছিলেন। কোচ বলরাজ তখন বলেন যে শুধু ১০০ করেই থেমে থাকলে হবে? আগামী কাল থেকে দ্বি-শতরানের জন্য শুরু হবে পথচলা। পরে যখন সুযোগ আসে হরিয়ানার বিরুদ্ধে রোহতাকে দ্বিশতরান করে কোচের কথা রেখেছিলেন বাদোনি। ছোটো থেকেই এরকম একরোখা জেদী মানসিকতার বাদোনির চলার পথটা কিন্তু এতটা সহজ ছিলনা। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসার কারণে বাদোনির মা ভয় পেতেন। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা হবার কারণে চাইতেন ছেলে পড়াশোনায় মন দিক। এই সুবিশাল জনসংখ্যার দেশে ক্রিকেটে কি জায়গা পাবে ছেলে? স্বপ্ন দেখারও তো একটা বাস্তবতা থাকতে হবে!
O২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের সময় থেকে তদানীন্তন ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের নজরে ছিলেন বাদোনি। ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৮ বলে ৫২ রান করে অপরাজিত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি যুব টেস্ট ম্যাচে ১৮৫ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেললেও অধরা থেকে যায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলের টিকিট। দিল্লির ঘরোয়া ক্রিকেটেও একই হাল। রাজধানীর ক্রিকেট সার্কিটে একটা কথা বলা হয় যে, সনেট ক্রিকেট ক্লাব থেকে উঠে আসা ছেলেরা বিশেষ সুযোগ সুবিধা পায় টিম দিল্লিতে। বর্তমান ভারতীয় উইকেট-রক্ষক ঋষভ পন্থও যেখান থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু বাদোনির ক্ষেত্রে বারংবার যোগ্যতা প্রমাণ করেও মেলেনি সুযোগ। পরপর তিনবছর আইপিএল নিলামে নাম উঠেও অবিক্রিত থেকে যেতে হয় বাদোনি কে। আর আইপিএলের কোন দল নেবেই বা কেন কোনো এক অখ্যাত বাদোনি কে? গতবছর সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে দিল্লির হয়ে ব্যাট করার সুযোগ এসেছে মাত্র একটি ম্যাচে। তাতেও আবার রানসংখ্যা মাত্র আট!
কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না রতনে রতন চেনে। আর দিল্লি ক্রিকেটের এই রতনটিকে চিনতে কোনো ভুল করেননি প্রাক্তন ভারতীয় ওপেনার ও বর্তমান লখনউ দলের মেন্টর গৌতম গম্ভীর। বাদোনি বলেছেন গৌতি ভাই বারবার বলতেন একটা ম্যাচ নয়, নিজেকে প্রমাণ করার অনেক সুযোগ আসবে। আর কথা রেখেছেনও গৌতি ভাই। গত ফেব্রুয়ারিতে অকশন টেবিলে মাত্র কুড়ি লক্ষ টাকায় বছর বাইশের বাদোনিকে লখনউ দলে তুলে নিয়ে এবং প্রথম ম্যাচে শুধু প্রথম এগারোতেই নয় চাপের মুখে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ক্রুনাল পান্ডিয়ার আগে তাকে ব্যাট করতে পাঠিয়ে। আর সুযোগ পেয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলেন বাদোনিও। নাহলে কি আর ওরকম সিচুয়েশনে মাথা ঠান্ডা রেখে হার্দিক পান্ডিয়া, রশিদ খান আর লকি ফার্গুসন কে উড়িয়ে দিতে পারতেন অবলীলায়? যে তিনটি শট নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেছে গতরাতের পর থেকে, আর নামের আদ্যাক্ষরে ও ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে সাদৃশ্য থাকায় দলের অধিনায়ক কে এল রাহুল বলছেন, “বেবি ডি ভিলিয়ার্স!”
কিন্তু পাঞ্জাবে নিজের ঘরে বসে খেলা দেখতে দেখতে হেসে ওঠেন ছেলেবেলার কোচ বলরাজ স্যার। বলেন, এরকম শট ও ৯ বছর বয়স থেকে খেলে। ও এমনই। আমাদের দেশে এরকমই নিঃশব্দে থেকে যান গুরু দ্রোণাচার্যেরা। শিষ্যের সাফল্যে মুখে ফুটে ওঠে হাসি, গর্বে ফুলে যায় বুক আর চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণ। ভাগ্যিস এই বলরাজ স্যাররা ছিলেন নাহলে অচিরেই হারিয়ে যেতো হয়তো গতরাতের পর থেকে ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং আয়ুষ বাদোনিরা। তবে সাফল্যকে সহজে মাথায় চড়তে না দিয়ে লক্ষ্য স্থির রাখতে জানেন বাদোনি, আসলে সাফল্য সহজে আসেনি কিনা। তাই আপাতত পাখির চোখ ভারতীয় সিনিয়র দলের নীল জার্সিটা।