ভারতীয় ক্রিকেটকে যেমন প্রাক ২৫ জুন ১৯৮৩ আর ২৫ জুন ১৯৮৩ পরবর্তী, এই দুটো টাইমজোনে ভাগ করে দিয়েছিল ঐ তারিখটায় ভারতের বিশ্বকাপ জয়, ঠিক একইভাবে ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপে একটা লোকের ওপেনিং ব্যাটিং ওডিআই ক্রিকেটকে ভাগ করে দিয়েছিল দুটো টাইমজোনে, প্রাক ১৯৯৬ আর ১৯৯৬ পরবর্তী। শ্রীলঙ্কা তথা বিশ্ব ক্রিকেটে “একদিন সূর্যের ভোর” এনে দিয়েছিল লোকটা।
লোকটা ব্যাট হাতে ক্রিজে এসে স্টান্স নিলেই ভয়ের একটা হিল্লোল ঊঠত মনের মধ্যে আর আমি তার মধ্যেও সলিল চৌধুরীর কথা-সুর উপলব্ধি করতাম:-
“আহ্বান, শোনো আহ্বান, আসে মাঠ-ঘাট বন পেরিয়ে।
দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে, বন্যার মত বেরিয়ে।“
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণপ্রান্তে মাতারা নামক ছোট্ট মাঝ ধরার বন্দরের বাসিন্দা ছিল লোকটা, যখন সে ছিল ছেলেটা। যখন সে খুব ছোট ছিল, তখন কলম্বো থেকে ব্যাট কিনে আনতেন তার বাবা। বাবার এনে দেওয়া ব্যাট দিয়ে কখনো বাবারই এনে দেওয়া রবারের বল, কখনো বা আধলা ইঁট পেটাতো ছেলেটা। সে এত জোরে ব্যাট দিয়ে বল মারত যে তা জলে হারিয়ে যেত। আবার তাকে বাবার কাছেই আবদার করতে হত নতুন বলের জন্য। মাতারার জেলেরা রোজ দেখত ছেলেটাকে আর বুঝতে পারত যে এই ছেলেটার দৃষ্টিশক্তি দারুণ ভালো কেননা সে অনেক দূরের জিনিস খালি চোখে দেখতে পায়। তাই যখন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসতো সমুদ্রতীরে, তখন তারা তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করত, কারণ মাছের ট্রলিগুলো তখন ঘরে ফিরত।সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে বলতে হত ক’টা ট্রলি ফিরে আসছে, আর ক’টা অনেক পিছিয়ে আছে।
তারপরে একদিন ছেলেটা ২০ বছরেই মাথায় টাক পড়ে যাওয়া যুবকটা হয়ে গেল আর বাবার প্রশ্রয়ে বাঁচিয়ে রাখা বল পেটাবার নেশাটা সঙ্গে নিয়ে কলম্বোয় গেল দেশের হয়ে বাছাইয়ের জন্য নেট প্র্যাক্টিসে।সেখানেও সেই “চোখের দেখা” আর “বল পেটানো” চালু হল। নেটে দলের ক্যাপ্টেন বললেন এভাবে বল না দেখে অন্ধের মত ব্যাট চালালে নেট থেকেই বার করে দেবেন। একটু থমকালো যুবকটা। কয়েকটা বল ডিফেন্স করল, হাত নিশপিশ করা লুকিয়ে রেখে। কিছু পরে তাকে বল করতে এলেন তখনকার সেরা, একনম্বর বোলার রুমেশ রত্নায়েকে। আর আবার সেই যুবকটা বিনা হেলমেটে বিনা বাক্যব্যয়ে প্রচণ্ড জোরে হুক করে আর স্টেপ আউট করে লিফট করে রুমেশ রত্নায়েকে উড়িয়ে দেওয়া শুরু করে দিল আর নজর রাখল ক্যাপ্টেনের দিকে। এই বুঝি আবার বকুনি খায় সে! কিন্তু কোথায় কি? ছোটবেলার সেই মাতারার জেলেদের মতই তার ক্যাপ্টেনও ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন, কি জিনিস চলে এসেছে তার হাতের মুঠোয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, তার ক্যাপ্টেন অর্জুন রণতুঙ্গা তার ঘর্মাক্ত মাথা মুছিয়ে দিচ্ছেন। তার সিরিয়াসনেসের অভাব উপেক্ষা করেই সেই ১৯৮৯য়েই দেশের ওডিআই টিমে ডেবিউ হয়ে গেল তার। কিছু পরে টেস্টে আর অনেক পরে টি২০তেও দেশের হয়ে খেলে ফেলল সে।যুবকটা ততদিনে হয়ে গেছে লোকটা।
প্রথমদিকে অবশ্য ওই সিরিয়াসনেসের অভাবেই সাফল্য লোকটার বন্ধু হয়নি, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ অবধি শ্রীলঙ্কার হয়ে খুব অল্প ম্যাচই খেলেছিলেন তিনি। অবশ্য তাঁর সফল হওয়াটা হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী, এবং তা হয়েও ছিল তার পরেই। যার ফলশ্রুতি তাঁর ২২ বছরের (১৯৮৯-২০১১) আন্তর্জাতিক কেরিয়ার, ৫৮৬টিআন্তর্জাতিক ম্যাচ, ২১,০৩২টি আন্তর্জাতিক রান, ৪৪০টি আন্তর্জাতিক উইকেট। টানা ৩৮ টেস্টে শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর ৩৪০, টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চর তালিকায় আজও সপ্তম স্থানে আছে।
১৬ বছর ১০ মাসে (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ – ডিসেম্বর ২০০৭) ১১০টি টেস্ট খেলে ১৮৮ ইনিংসে ৪০.০৭ গড়ে ১টি ত্রিশতরান ও ২টি দ্বিশতরান সহ মোট ১৪টি শতরান আর ৩১টি অর্ধশতরান ছিল তাঁর ৬,৯৭৩ রানে (সর্বোচ্চ ভারতের বিরুদ্ধে ৩৪০), উইকেট নিয়েছেন ৯৮টি (ইনিংস সেরা বোলিং ৫/৩৪ ও ম্যাচ সেরা বোলিং ৯/৭৪) আর ৭৮টি ক্যাচও নিয়েছেন তিনি।
আর ২১ বছর ৬ মাসে (ডিসেম্বর ১৯৮৯ – জুন ২০১১) ৪৪৫টি ওডিআইতে ৪৩৩ ইনিংসে ৩২.৩৬ গড়ে (স্ট্রাইক রেট ৯১.২০) ২৮টি শতরান আর ৬৮টি অর্ধশতরান ছিল তাঁর ১৩,৪৩০ রানে (সর্বোচ্চ ভারতের বিরুদ্ধে ১৮৯), উইকেট নিয়েছেন ৩২৩টি (ইনিংস/ম্যাচ সেরা বোলিং ৬/২৯) আর ১২৩টি ওডিআই ক্যাচও আছে তার সংগ্রহে।
আর ৫ বছরে (জুন ২০০৬ – জুন ২০১১) ৩১টি টি২০ ম্যাচে ৩০ ইনিংসে ২৩.২৯ গড়ে (স্ট্রাইক রেট ১২৯.১৫) ৪টি অর্ধশতরান ছিল তাঁর ৬২৯ রানে (সর্বোচ্চ ৮৮), উইকেট নিয়েছেন ১৯টি (ইনিংস/ম্যাচ সেরা বোলিং ৩/২১) আর ৪টি টি২০ ক্যাচও নিয়েছেন তিনি।
এই বিপুল তথ্যসম্ভার সাজানো রয়ে গেছে রেকর্ডবুকে। কিন্তু রেকর্ডবুক কোনদিন জানাবেনা তাঁর দ্বারা উৎপন্ন প্রবল ভয়ের তরঙ্গ, তিনি ব্যাট হাতে ক্রিজে এসে স্টান্স নিলেই যা আছড়ে পড়ত বিপক্ষ দল, বোলার ও সমর্থকদের চেতনায়। বিশেষত ওডিআই-তে আগে বা পরে যখনই ব্যাটিং করুন, প্রথম ১৫ ওভারেই বিপক্ষ বোলারদের তুলোধোনা করে শুরুতেই ম্যাচের দখল কিভাবে নিতে হয় তা ক্রিকেট দুনিয়া প্রথম দেখেছিল তাঁকে দেখে, ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপে (শ্রীলঙ্কা প্রথম আর শেষবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেবার)। ঐ বিশ্বকাপেই গ্রুপের খেলায় দিল্লীতে ভারতের ৫০ ওভারে ২৭১/৩-এর জবাবে রমেশ কালুভিথরণাকে নিয়ে মনোজ প্রভাকর-শ্রীনাথকে যথেচ্ছ পিটিয়ে প্রথম ৩ ওভারেই ৪৭/০ রান তুলে ম্যাচের দখল নেয় শ্রীলঙ্কা, যার মধ্যে তাঁর সংগ্রহই ছিল ৩৩ (৭৬ বলে ৭৯ করেছিলেন শেষ অবধি)। শারজায় ভারতের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে ১৬১ বলে ১৮৯ বা কলম্বো টেস্টে ১৯৯৭ সালে ভারতেরই বিরুদ্ধে ৩৪০ রান, ২০০৪-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফয়সালাবাদ টেস্টে ২৫৩, ১৯৯৬-এ সিঙ্গাপুরের পাডাংয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওডিআই-তে ৬৫ বলে ১৩৪, ২০০৬-এ হেডিংলে ওডিআই-তে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৯৯ বলে ১৫২ বা ২০০৮-এ করাচী ওডিআই-তে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৮৮ বলে ১৩০ আজও প্রতিপক্ষ শিবিরে বিস্ফোরণ ঘটানোর রূপকথা হয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। নব্বই দশকে এটাও রটে গিয়েছিল যে লোকটার ব্যাটে লাগানো আছে একটা বিশেষ স্প্রিং, যা ছাড়া এমন ভাবে মারা কার্যত অসম্ভব।
তারপরে এল জানুয়ারী ২০১৮। ছোট্ট একটা খবর পড়লাম। হাঁটুর ব্যথায় ক্রাচ ছাড়া হাঁটতেও কষ্ট এই লোকটার। মনটা কেমন হয়ে গেল। বুকে কিরকম একটা কষ্ট। বিশ্বাস করুন আপনারা, আমাদের বোলারদের যখন তুলোধোনা করতেন এই লোকটা, তখনও এতটা কষ্ট হতনা।আসলে সময়ের চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক কেউ হয় না! সময়ের ফেরে এই লোকটা ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না আর ভাস্কর গাঙ্গুলীর পার্কিনসন্স রোগ হয়!
এর এক বছর পরে ২০১৯য়ের ফেব্রুয়ারিতে কষ্টটা আরো বাড়ল।যেদিন India Today Web Desk-এ এই খবরটা পড়লাম:-
“Sanath Jayasuriya, Sri Lankan cricket legend and World Cup winner, has been accused of smuggling ‘rotten betel nuts’ into India. According to media reports, a businessman named Jayasuriya and two other cricketers (whose names were not revealed) after the Director of Revenue Intelligence seized betel nuts worth several crores of rupees in Nagpur. This is not the first whiff of controversy for Jayasuriya. He was charged with breaching the ICC Anti-Corruption Code…Jayasuriya, one of the heroes of Sri Lanka’s 1996 World Cup triumph and a former chairman of selectors was charged with breaching the ICC Code of Conduct in October.
খবরটার শেষ প্যারাটা ছিল এইরকম:-
Jayasuriya is one of Sri Lankan cricket’s greatest heroes. In 445 ODIs, he scored 13,430 runs including 28 hundreds. In 110 Tests, he scored 6,973 runs including 14 hundreds.
আমি এখনও এই খবরটার শেষ প্যারাটাতেই থাকতে চাইছি। লোকটাকে এই পরিচয়েই চিনতে চাই আজীবন। কেন না, আমি তো জানি নব্বই দশকের যুবক, তরুণ, কিশোর, শিশুরা আজও খোঁজে, লোকটার ব্যাটে না লাগানো অথবা লাগানো স্প্রিংটা।
১৯৮৯ থেকে ২০১১, এই সুদীর্ঘ ২২ বছর মাঠে আর টিভিতে আপনাকে খেলতে দেখার কসম, তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যান আর ভাল থাকুন আপনি, একদা ওডিআই ওপেনিংএর মানে পাল্টে দেওয়া বিশ্বত্রাস সনথ জয়সূর্য।