এক আশ্চর্য প্রতিভার অকাল মৃত্যু

তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি কেউ। মনে রাখার কথাও নয়, কারণ বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশকেই ইতিহাস রক্ষার গুরুত্ব বোঝানো হয়নি কখনও। রুশি মোদি তেমনই এক ক্রিকেটার, রঙিন সম্ভাবনা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে আবির্ভূত হলেও পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগে অকালেই যিনি হারিয়ে যান।

না, নিঃশব্দে নয়, প্রবেশের শব্দ তুলেই ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর আগমন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে (বোম্বাই পেন্টাঙ্গুলার) আবির্ভাবেই সেঞ্চুরি দিয়ে তাঁর ক্রিকেট মঞ্চে পা-রাখা। ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি রঞ্জি ট্রফিতে দুই বিজয়—মার্চেন্ট আর হাজারের ব্যাটের শাসনে শিহরিত সময়ে, ৬ ফুট লম্বা, ফর্সা, শীর্ণকায় এই ব্যাটারের শৈল্পিক খেলা চোখ টানে সবার। ১৯৪৩-৪৪ আর ১৯৪৪-৪৫ এই দুই মরশুমে রঞ্জি ট্রফিতে অলৌকিক ব্যাটিং প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। বোম্বাইয়ের হয়ে টানা ৫ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে চলে আসেন ক্রিকেটপ্রেমীদের যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রথম সিজনে মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে ১৬৮, এবং পশ্চিম ভারতের বিপক্ষে ১২৮ অর্থাৎ দু’টি শতরান করেন। ঠিক পরের মরশুমের শুরুতেই সিন্ধুপ্রদেশের বিরুদ্ধে ১৬০, পশ্চিম ভারতের বিপক্ষে ২১০, বরোদার বিপক্ষে হাঁকান অপরাজিত ২৪৫। এবং উত্তর ভারত (১১৩) আর হোলকারের (১৫১) বিরুদ্ধে আরও দু’টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করায়, মোট সাত ম্যাচে তাঁর সেঞ্চুরি দাঁড়ায় ৭টি! হাজারে এবং মার্চেন্টের মতো কীর্তিমান ব্যাটার থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২০ বছর বয়সী সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ একটি ছেলে রঞ্জির এক মরশুমে ৫ ম্যাচে, ২০১.৬০ গড়ে ১,০০৮ রানের রেকর্ড তৈরি করে ফেললে নজর তো সেই দিকে পড়বেই (দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে ডব্লিউ ভি রামন ১,০১৮ রান করে নতুন নজির গড়েন।)। ইতিমধ্যে কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্টে পার্শিদের হয়ে ২১৫ রানের ইনিংস খেলেন। এর পরেই আসে সেই চমকপ্রদ ইনিংস, অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস একাদশের বিরুদ্ধে। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘ডবল সেঞ্চুরি’-টি (২০৩) হাঁকান রুশি মোদিই। বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ বি বি মামা তাঁর ‘Some Indian Crickerers’ বইতে লিখেছিলেন “২১ বছরের কম বয়সে ডন ব্র্যাডম্যানকেও ছাপিয়ে যান মোদি। ডন যেখানে ৩৪ ইনিংসে ৭৮ গড়ে মোট ২,১০৬ রান করেছিলেন, সেখানে রুশি মোদি মাত্র ২৬ ইনিংসেই ১০১.২৭ গড়ে ২,২২৮ রান করেছিলেন!অর্থাৎ ৮ ইনিংস কম খেলেও বেশি রান করেছিলেন মোদি। এমনকি, তাঁর গড়ও ছিল উন্নততর।”

১৯৪৬ সালের ‘ভিজে’ সামারে ভারতের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে যান মোদি। লর্ডসে আলেক বেডসার ১১ উইকেট নিলেও আবির্ভাব টেস্টে মোদি অপরাজিত ৫৭ রান করেন, যার মধ্যে নির্ভরতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তিন টেস্টে তাঁর ১৩৭ রান ছিল দু’দেশের মধ্যে পঞ্চম এবং ভারতীয়দের মধ্যে বিজয় মার্চেন্টের পরেই।সফরে করেন মোট ১,১৯৬ রান। সেই সফরে মাত্র চারজন ভারতীয় হাজার রানের গন্ডি পার হয়েছিলেন।১৯৪৭-৪৮ অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যক্তিগত কারণে যাননি মোদি। তখনকার দিনে জলযানে বিদেশ সফর মানে ৩-৪ মাসের ধাক্কা। ডিকি রত্নাগরের মতো ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলেছিলেন শারীরিক কারণ হয়তো ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ মোদিকে একটা বৃহৎ পরিবার দেখাশোনা করতে হত। এতদিন বাড়ির বাইরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে ১৯৪৮-৪৯ সালে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ভারত সফরে আসে তখন অবশ্য ভারতীয় টেস্ট দলে তিনি ডাক পান। এবং তাঁর ব্যাটিং-প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ ঘটান সিরিজে একটি সেঞ্চুরি (ব্রাবোর্নে ১১২) ও ৫টি ফিফটিসহ মোট ৫৬০ রান করে, যা ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক এবং দু’দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। বিজয় হাজারের সঙ্গে অন্তত চার বার শতরানের পার্টনারশিপও গড়েন তিনি। ১৯৪৯-৫০ সালে কমনওয়েলথ একাদশের বিরুদ্ধে ব্রাবোর্নে বে-সরকারি টেস্টের দু’ইনিংসে দুটি ‘ফিফটি’ হাঁকান ।

জীবনে মাত্র ১০টি টেস্ট খেলা এই ক্রিকেটারের ৪৬.০০ গড়ে ৭৩৬ রান কিংবা প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০৫ ম্যাচে ৫৩.০২ গড়ে ২০টি সেঞ্চুরি ও ৩৯টি ফিফটিসহ ৭,৫২৯ রান দেখে সেভাবে বোঝার কোনও উপায় নেই রুশি মোদি কি স্তরের ব্যাটার ছিলেন। ১৯৯৬ সালের আজকের তারিখে (১৭ মে) চিরকালের প্রিয়তম আশ্রয়স্থল ‘ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া’য় বসে থাকার সময়ে আচমকাই হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর।বিজয় হাজারে তাঁর ‘লং ইনিংস’ বইতে টিম-মেট সম্পর্কে লিখেছিলেন “রুশির ব্যাটিংয়ে শক্তি নয়, ছিল অসাধারণ স্টাইল। নিখুঁত সময়জ্ঞান আর প্লেসিংয়ের সঙ্গে ছিল রেশমের মতো মসৃণ কভার-ড্রাইভ! রুশি ক্রিকেটে এসেছিল ফুল ফুটিয়ে কিন্তু পূর্ণ বিকাশের আগে সরে গেল হঠাৎই, চলেও গেল আচমকাই।”

তাই বলছিলাম এমন বিষণ্ণ খবরগুলো আড়ালেই থেকে যায়, কেউ মনে করিয়ে না দিলে।