গত মার্চে প্রয়াত হয়েছিলেন তাঁর মা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। তখন ভারত সফরে এসে খেলতে ব্যস্ত ছিল অস্ট্রেলিয়া। মা’র জীবনাবসানের খবর পেয়ে এদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় উড়ে গিয়েছিলেন প্যাট কামিন্স। শোকের সেই আবহ কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল তাঁর। হয়তো এই শোকই কামিন্সের মানসিক কাঠিন্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিছুদিনের মধ্যেই আমরা ঢুকে পড়েছিলাম আইপিএলের দুমধাড়াক্কা ক্রিকেট গ্রহে। কিন্তু সেই স্রোতে গা ভাসাতে চাননি কামিন্স। আইপিএল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মূলত দুটি কারণে। এক, আইপিএলের পরেই ছিল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। এই প্রতিযোগিতাকে বলা হয় ‘টেস্টের বিশ্বকাপ’। দু’মাস ধরে আইপিএল খেলে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে সেই ফাইনালে অংশ নেওয়াকে মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেননি কামিন্স। দুই, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পরেই ঐতিহ্যশালী অ্যাশেজ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ টেস্টের মহাসিরিজ। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশকে নেতৃত্ব দিতে যে মানসিক প্রস্তুতি লাগে, আইপিএল না খেলে সেই ব্যাপারে মনঃসংযোগ করাকেই অধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন কামিন্স।
প্রথম লক্ষ্যে সফল হয়েছেন তিনি। ওভালে ভারতকে দাপটের সঙ্গে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় লক্ষ্যে সফল হওয়ার ক্ষেত্রেও কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া আগুয়ান। পাঁচদিনের জমজমাট, প্রাণবন্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ের পর এজবাস্টনে অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে জয়ী অসিরা। শেষ দিনে শেষমুহূর্তে বেন স্টোকসদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে দলকে রুদ্ধশ্বাস জয় এনে দিয়েছেন সেই কামিন্সই। আট উইকেটের পতন। জেতার জন্য তখনও দরকার ৫০–এর বেশি রান। ঘাড়ে চেপে বসেছে ইংল্যান্ড। তুমুল চাপের মুখে, চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে, লায়নকে সঙ্গী করে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছেন অধিনায়ক কামিন্স। তাঁর অপরাজিত ৪৪ রানের ইনিংসকে মহাকাব্যিক বললেও কম বলা হবে না। টেস্টের প্রথম বল, কামিন্সকে চার মেরে শুরু করেছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু কামিন্সের মারা চারেই ইংল্যান্ডের বাজবলের গতিকে থামিয়ে দিয়েছে অসিরা। অনন্ত চাপের মুখেও যেভাবে তিনি মাথা ঠান্ডা রেখে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, তাতে কামিন্সকেই টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ‘ক্যাপ্টেন কুল’ বলছেন বীরেন্দ্র শেহবাগ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে প্যাট কামিন্স মোটেই হোমড়া–চোমড়া বা ওজনদার নাম নন, কিন্তু পরিশ্রম এবং পরম নিষ্ঠায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেশকে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়, উদাহরণ তৈরি করছেন কামিন্স। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর দল হিসেবে যেভাবে খেলা উচিত, অ্যাশেজের প্রথম ম্যাচে তারই পরিচয় দিয়েছে কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া। ইংরেজদের ভয়ডরহীন ক্রিকেটের বিপরীতে ধৈর্য, অসীম জেদ এহং সংযমের মিশেল। কামিন্সকে দেখে কি রোহিত শর্মা কিছু শিখবেন? দু’মাসের আইপিএল এবং বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল খেলে চরম ক্লান্ত রোহিত অবশ্য এখন ব্যস্ত আছেন পরিবার নিয়ে ইওরোপ ভ্রমণে।
আরও একজনের কথা না লিখলেই নয়। উসমান খোয়াজা। কী অনবদ্য ক্রিকেটটাই না তিনি খেললেন! ধৈর্য, ধৈর্য আর ধৈর্য। এই নীতিতেই অটল থেকে এজবাস্টন টেস্টের পাঁচদিনই খোয়াজাকে দেখা গিয়েছে বাইশ গজে সময় কাটাতে। প্রথম ইনিংসে তাঁর রান ১৪১, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫। মোট ৫১৮ বল খেলেছেন ৭৯৬ মিনিট ধরে! এজবাস্টন টেস্টের সামগ্রিক পর্যালোচনা করলে এটা বলাই যায় যে, একা খোয়াজাই প্রায় হারিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। ফিনিশিং টাচটা দিয়েছেন নেতা কামিন্স।
টি২০ ক্রিকেটের মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকা ভারতের ব্যাটাররা সাদা জার্সিতে ক্রিজে গিয়ে ধৈর্যের সংজ্ঞা ভুলে যান। একটু বাইরের বল দেখলেই লোভের লালা গড়িয়ে পড়ে মুখ থেকে। টেস্ট ক্রিকেটের পাঠ খোয়াজাদের থেকে একটু–আধটু নিলে আপনাদেরই লাভ। দেশ ও দশের লাভ।