সবুজ মাঠ, দর্শকভরা গ্যালারি, ক্রিজে দুজন ব্যাটার। ডাগ-আউট থেকে ক্যাপ্টেন ইশারা করে ডেকে নিচ্ছেন ব্যাটারদ্বয়কে। নিটোল ক্রিকেটপ্রেমীরা বলবেন ‘এ তো টেস্ট ক্রিকেটের অতিপরিচিত এক দৃশ্য।’ হ্যাঁ ঠিক তাই। যেন ক্যাপ্টেন পর্যাপ্ত রানের গন্ডিতে পৌছে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিতে চাইছেন।
কিন্তু শুক্রবার ওয়াংখেড়েতে চলতি আইপিএলে এমন ঘটনারই সাক্ষী থাকলেন বহু মানুষ। কুড়ি-কুড়ির খেলা, যার কিনা পাঁচদিনের টেস্টের সাথে হাজার মাইলের দূরত্ব সেখানে এহেন দৃশ্যের প্রাসঙ্গিকতা কী?
সেঞ্চুরিয়ন বাটলারের নির্মম প্রহার এবং স্যামসনের অভাবনীয় ইনিংসের ফসলস্বরূপ ২২৩ রান তাড়া করতে নামে দিল্লি ক্যাপিটালস। ম্যাচ গিয়ে শেষপর্যন্ত দাঁড়ায় ৬ বলে ৩৬ এ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১১ বলেও এই একই রান প্রয়োজন ছিল দিল্লির। তাই অঙ্কটা যখন ছ’বলে এসে দাঁড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই টিভির এপারের মানুষজন এটিকে কার্যত অসম্ভব বলেই ধরে নেয়।
স্ট্রাইকে রয়েছেন রভম্যান পাওয়েল। বাঁহাতি ম্যাককয়কে পরপর দু’বলে দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে অভিনবভাবে জানান দিলেন নিজের উপস্থিতি। ক্রিজে থাকা খেলোয়াড়ের জন্মস্থানটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ হওয়ার কারনে আপামর ক্রিকেটপ্রেমীর মনে বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ় হতে থাকে।
কথায় আছে “ঘুমিয়ে আছে সকল পিতা, সব শিশুরই অন্তরে”। কেউ কেউ মনে হয় এই ছড়াটিকেই একটু সংযোজন করে ‘পিতা’-কে ‘রাসেল’ এবং ‘শিশু’ কে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিলেন।
বিতর্কটা দানা বাঁধতে শুরু করল তৃতীয় বলে পাওয়েল ছক্কাটা হাঁকানোর পরই। আম্পায়ার নিঃসংকোচে এটিকে ফুলটস বলে দাবি করলেও ওই সময় ব্যাটারের মাটি থেকে কোমরের উচ্চতা এবং বলের উচ্চতার পার্থক্য পরিষ্কার বলে দিচ্ছে এই বল বিধিসম্মত নয়। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে ‘নো-বল’। কিন্তু অনফিল্ড আম্পায়ার নীতিন মেনন তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়।
হঠাৎই এই সময় ডাগ-আউট থেকে ব্যাটারদের ফিরে চলে আসার ইশারা করতে থাকেন দিল্লি অধিনায়ক ঋষভ পন্থ। বাউন্ডারি লাইনের ধারে বাটলারের সাথে হয়তো কিছু বাক্য-বিনিময়ও হয় তাঁর। প্রবীণ আমরে মাঠে প্রবেশ করে আম্পায়ারের সাথে কথাও বলে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই গ্যালারিতে জনকন্ঠ তীব্রতর হতে থাকে।
চলুন একটু ঘুরে আসা যাক তিন বছর আগে, ২০১৯ সাল থেকে। যেখানে এই ‘নো-বল’ বিতর্ককে ঘিরেই মাঠে প্রবেশ করে আম্পায়ারের সাথে কথা বলতে দেখা যায় খোদ মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। পরেরদিনের মুখরোচক খাবারের আর অভাব হয়নি নিউজ মিডিয়ার। পাবলিকও ভালোই খেয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে এই ম্যাচটিও ছিল রাজস্থানের সাথেই। এদিনেরটা সমাপতন?
চলুন আরেকটু পুরোনো দিনে ঘুরে আসা যাক। মেলবোর্ন, ১৯৮১। গাভাসকার তখন সত্তর-এ ব্যাট করছেন। আম্পায়ার তাঁর প্যাডে লাগা একটি বলে আউটের সিদ্ধান্ত জানালে তিনি চেতন চৌহানকে নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও ভারতীয় ম্যানেজার পরিস্থিতি সামাল দেন।
আজকে ঋষভ পন্থকে নিয়ে কথা বললে আঙ্গুলটা ধোনি এবং গাভাসকারের দিকেও উঠুক। এক্ষেত্রে তিনটে ঘটনাই অন্যায়।
এক্ষেত্রে যদি বা ‘হিট অব দ্য মোমেন্ট’-এর দোহাই দিয়ে এই তিনজন খেলোয়াড়ের কর্মকান্ডকে যদিও বা লঘু করে দেখা যায়, দিল্লির কোচ হিসেবে প্রবীণ আমরের মাঠে প্রবেশকে তো কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কারন কোচ হিসেবে তাঁর কাজটাই সেই সময়ে খেলোয়াড়দের শান্ত করা, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে না দেওয়া। সেখানে তিনি নিজে নিয়ম ভেঙে মাঠে ঢুকে পড়লেন!
যাইহোক, সাময়িকভাবে আম্পায়ারদের হস্তক্ষেপে ঝামেলার পরিসমাপ্তি ঘটলে খেলা আবার শুরু হয়। কিন্তু পাওয়েল ব্যর্থ হন বাজিমাত করতে।
এই বিতর্কের ড্রামাতে দিল্লির যে আখেরে লাভ কিছুই হলো না তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মিনিট পাঁচ-সাতের এই বিরতি ন্যায্য বিচার তো দিলই না বরং উল্টে রভম্যান পাওয়েল ছন্দ হারিয়ে শেষ বলে আউট হয়ে ফিরলেন।
ফলাফল নিয়ে আলোচনা ছেড়ে একটু চলতি আইপিএলে আম্পায়ারিং নিয়ে কিছু বলা যাক।
আচ্ছা ওভারস্টেপিং-এ নো-বল কিংবা সহজ রান-আউটের অ্যাপিলেও যে অন-ফিল্ড আম্পায়াররা বারবার ভিডিও রিপ্লে দেখেন কিংবা থার্ড আম্পায়ার ডিসিশন দেন, তাঁরা কী একটা হাই-ফুলটস চেক করে দেখতে পারতেন না? এটা পক্ষপাতিত্বের নিদর্শন নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস?
যে সিদ্ধান্তের ওপর একটা ম্যাচের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করে আছে, সেটা নেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নশীল হওয়া যেত না?
এর আগে এই ‘নো-বল বিতর্ক’ ছাড়াও অনেক ম্যাচে বহু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে আম্পায়ারকে। আজকের এই টেকনোলজি সর্বস্ব যুগে এমন ঘটনা সত্যিই হতাশাজনক।
ঋষভদের হাত থেকে হয়তো একটা ম্যাচ ফস্কে গেল, কিন্তু আপনার পছন্দের খেলোয়াড়ের হাত থেকে যদি খোদ কাপটাই ফস্কে যায়?