২০০৮ সালের ১লা মার্চ – চট্টগ্রামের এক টেস্ট-ম্যাচে ভেঙ্গে গেল ১৯৫৬ সালের ৭ই জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাদ্রাজ টেস্টে দুই ভারতীয়ের গড়া ৪১৩ রানের ওপেনিং জুটির সেই বিশ্বরেকর্ড। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৪১৫ রানের আরেক ওপেনিং জুটি গড়ে ৫২ বছরেরও বেশি আগেকার বিশ্বরেকর্ডটা ভাঙ্গলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনিং জুটি নীল ম্যাকেঞ্জি (২২৬) ও গ্রেম স্মিথ (২৩২) – আর একই সঙ্গে তাঁরা ভাঙ্গলেন প্রায় ৪৩ বছরেরও বেশি আগেকার, ১৯৬৫ সালের ৬ই মে তারিখে, ব্রিজটাউনে গড়া আরেকটি টেস্ট ওপেনিং বিশ্বরেকর্ডও। আসুন, একটু ফিরে দেখা যাক এই দ্বিতীয় ‘ভাঙ্গা’ রেকর্ডটার কথা।
ভেঙ্গে-যাওয়া প্রথম বিশ্বরেকর্ডটার কথা প্রায় সব ভারতীয় ক্রিকেট-প্রেমীই জানেন, বাঙালিরা তো বটেই – কারণটা? বলার দরকার আদৌ আছে কি – সঙ্গের ছবিটাই যে যথেষ্ট!
ভেঙ্গে-যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বরেকর্ডটা কি? টেস্টে ওপেনিং জুটির দু’জন ব্যাটারেরই দ্বিশতরান – প্রথমবার যা করেন অস্ট্রেলিয়ার ষাটের দশকের বিশ্বসেরা ওপেনিং জুটি, ববি সিম্পসন (২০১) ও বিল লরি (২১০)। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩৮২ রানের অস্ট্রেলিয়ার এই জুটির সঙ্গে ৪১৫ রানের দক্ষিণ আফ্রিকার সেই জুটির অন্তত আরো তিনটে মিল মনে করাই – দুই জুটিই বাম-দক্ষিণ যৌথ উদ্যোগ (লরি ও স্মিথ, এবং সিম্পসন ও ম্যাকেঞ্জি), দুই জুটিতেই অধিনায়কের সক্রিয় অংশগ্রহণ (সিম্পসন এবং স্মিথ) এবং দু’ক্ষেত্রেই বোল্ড আউট হয়ে অধিনায়কের বিদায়ে জুটি-ভঙ্গ [সিম্পসন বোল্ড হল এবং স্মিথ বোল্ড রাজ্জাক]।
এই তিনটে ওপেনিং জুটির এই তিন প্রদর্শনের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য অবশ্যই আছে, বিপক্ষের বোলিং-শক্তির সাপেক্ষে। কারোর কৃতিত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট না করেই বলি – ১৯৫৬ সালের ক্রিকেট-বিশ্বের দুর্বল অংশীদারদের অন্যতম নিউজিল্যান্ডের বা ২০০৮ সালের টেস্ট-ক্রিকেটের কনিষ্ঠতম দল বাংলাদেশের বোলিং-শক্তিকে কোনওভাবেই বিশ্বমানের বলা যেতোনা; অথচ ১৯৬৫ সালের সেরা দুই টেস্ট-দলের অন্যতম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং-বিভাগে ছিলেন ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ, গ্যারি সোবার্স ও ল্যান্স গিবস – দুরন্ত পেস, কৌশলী স্যুইং ও চাতুর্যে-ভরা স্পিন।
১৯৬৫ সালের ৫ই মার্চ শুরু হওয়া বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে কেনসিংটন ওভালের সেই টেস্টটা ছিল সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ, সোবার্সের দল তখন ২-০ ম্যাচে এগিয়ে। তখনও পর্যন্ত ঐ চার বোলারদের প্রত্যেকেই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটারদের ওপর যথেষ্ট আধিপত্য দেখিয়েছেন। এই ম্যাচে সফরকারী দল বাকি দুটো টেস্ট (ব্রিজটাউন ও পোর্ট অফ স্পেন) জিতে সিরিজে সমতা ফেরাতে বাড়তি উদ্যোগ নেয়। সিম্পসন টসে জিতে ব্যাটিং নেন। তাঁর সঙ্গী ওপেনার লরি তখনও পর্যন্ত ঐ সিরিজে তিন ম্যাচে পাঁচ ইনিংসে (১৯, ১৭, ১, ২০, ২২) ৭৯ রানের হতদরিদ্র পুঁজি নিয়ে ম্রিয়মাণ, ক্যারিবিয়ান বোলাররা তাঁকে বিব্রত করছেন – বিশেষত হল ও গ্রিফিথ। অতএব তখনও অবধি সিম্পসন-লরি জুড়ির সিরিজের সেরা ওপেনিং জুটি মাত্র ৩৯ রানের, তবু লরি দলে তাঁর জায়গা বজায় রেখে অধিনায়কের সঙ্গে আবার নামলেন ইনিংস শুরু করতে।
সিম্পসনের ভাষায়: “Australia’s failure in the first three Tests could be attributed to a large extent of Bill Lawry and me to get the team away to a good start. Lawry and I had failed as an opening pair three Tests in a row, something we had not experienced before. Naturally we were a little disheartened by this. By the start of the Fourth Test in Bridgetown, Barbados, we were determined to make amends.”
সেই দৃঢ় সঙ্কল্প এবার ফল দিল। প্রথম দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান বিনা উইকেটে ২৬৩ – সিম্পসন ১৩৭* আর লরি ১০২* – ওপেনিং জুটিতে অস্ট্রেলিয়ান টেস্ট-রেকর্ড হ’ল [১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে কেপ টাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বিল ব্রাউন ও জ্যাক ফিঙ্গলটনের ২৩৩ রানের ওপেনিং জুটির রেকর্ড ভেঙ্গে] – মজবুত রক্ষণ আর রান করবার সুযোগ পেলেই কাজে লাগানোর ফল। উইসডেন লিখল: “Simpson and Lawry mastered the bowling with such purpose that they batted throughout the first day for 263.”
ঐদিন খেলা হয় (ছ’বলের) ৮১ ওভার, প্রথম ঘন্টায় হল-গ্রিফিথ মাত্র ১০ ওভার বল করেছিলেন। [বর্তমানকালের ক্রিকেট-প্রেমীদের অবগতির জন্য এখানে একটু জানিয়ে রাখি যে] লাঞ্চের আগে একটা সময় ওভার-প্রতি তিনটে-চারটে বাউন্সার দেওয়ার জন্য গ্রিফিথকে আম্পায়ার সিসিল কিপিন্স প্রথমে ‘মৃদুভাবে সতর্ক’ করেন। এতে ফল হয় উল্টো, ক্ষেপে গিয়ে পরের ওভারে সিম্পসনকে গ্রিফিথ পাঁচ-পাঁচটা বাউন্সার দেন এবং তখন কিপিন্স তাঁকে official warning দেন – এরপর গ্রিফিথ ‘ঠান্ডা হতে’ বাধ্য হন। (হেলমেট ব্যবহার শুরুর প্রায় দেড়/পৌনে-দুই দশক আগে) গ্রিফিথের বাউন্সার কি জিনিস ছিল তার (তৎকালীন) কিছু সাক্ষীদের মধ্যে প্রাক্তন-হয়ে-যেতে-বাধ্য-হওয়া ভারতীয় অধিনায়ক-তথা-ওপেনার নরি কন্ট্রাকটরও আছেন। এই ‘ছোট্ট ছোট্ট’ সত্যিগুলো এই শতাব্দীর ক্রিকেট-প্রেমীদের জানা দরকার।
পরের দিন সেই জুটি ভাঙ্গে ৩৮২ রানের মাথায় যখন সিম্পসন ব্যক্তিগত ২০১ রানে হলের বলে বোল্ড হন। লরি চালিয়ে যান (বাঁ-হাতি বব কাউপার-এর সঙ্গে) দলের ৫২২ রান অবধি – আউট হন ‘অনিয়মিত’ বোলার জো সলোমন-এর বলে সোবার্সের হাতে ক্যাচ দিয়ে, তাঁর চতুর্থ ছক্কাটা মারতে গিয়ে। তারপর ঐদিন কাউপারও শতরান করেন (১০২), অস্ট্রেলিয়া দিন শেষ করে ৫৮৩-২ ক’রে। পরের দিন সিম্পসন ডিক্লেয়ার করেন মোট ৬৫০-৬ রানে (নর্ম্যান ও’নীল করেন ৫১), ১৮৯ ওভার খেলে – ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার মুখ্য বোলারই ‘সেঞ্চুরি’ করেন, হল ২৭-৩-১১৭-২, গ্রিফিথ ৩৫-৩-১৩১-০, সোবার্স ৩৭-৭-১৪৩-১ ও গিবস ৭৩-২৭-১৬৮-২ আর অনিয়মিত বোলার সলোমন ১৪-১-৪২-১ করেন।
ম্যাচটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ড্র হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জবাবে করে ৫৭৩ (২১২ ওভারে) – সেমুর নার্স ২০১, রোহন কানহাই ১২৯, কনরাড হান্ট ৭৫, গ্যারি সোবার্স ৫৫, চার্লি গ্রিফিথ ৫৪; এরপর অজিরা ৫৩ ওভারে ১৭৫-৪ (ও’নীল ৭৪*, লরি ৫৮ আহত-অবসৃত) ক’রে দান ছেড়ে দিলে ক্যারিবিয়ানরা ২৫৩ রান তাড়া ক’রে ৮৫ ওভারে ২৪২-৫ (হান্ট ৮১, ব্রায়ান ডেভিস ৬৮) তুললে উত্তেজনাকর অবস্থায় খেলা শেষ হয়। অজি পেসার গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি দু’ইনিংস মিলিয়ে ছ’টা উইকেট নেন, তাঁর জুড়ি নীল হক নেন চারটে; বিপক্ষের অফ-স্পিনার গিবস ম্যাচে চারটে উইকেট পান।
পরের টেস্টে, পোর্ট অফ স্পেনে, বোলিং-দাপটের খেলায় গ্রিফিথ ছ’টা, গিবস তিনটে ও সোবার্স একটা উইকেট নিলেও আরো জোরদার বোলিং ক’রে (ম্যাকেঞ্জি ও হক ছ’টা করে এবং বাঁ-হাতি রিস্ট-স্পিনার ডেভিড সিনকক চারটে উইকেট) অজিরা দশ উইকেটে জেতে। তার মধ্যেই ব্যাট হাতে জমিয়ে দেন প্রথম ইনিংসে কানহাই (দলের ২২৪-এর মধ্যে ১২১), দ্বিতীয় ইনিংসে হান্ট (দলের ১৩১-এর মধ্যে ৬০* – carried the bat); এবং সিম্পসন (৭২ ও ৩৪*) ও কাউপার (৬৯) করেন। তবে ২-১ ম্যাচে ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি প্রথমবার জিতে নেয় গ্যারির ওয়েস্ট ইন্ডিজ।