“ভারত-পাকিস্তান সম্প্রীতি আর সম্ভব নয়, বুঝলে কাকা?”
পাড়ার চায়ের দোকানের খাঁদু বলছিল আমায়। “এই যে তোমরা লিবারালরা এসব বুলি কপাচাও, এগুলোর জন্যেই দেশের এই অবস্থা হয়েছে। আরে শত্রুর সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব কী? সব শালা টেররিস্ট। মানুষ নাকি ওগুলো?”
খাঁদুর সঙ্গে তর্কে গেলাম না। খাঁদুদের সঙ্গে তর্কে যাওয়া যায় না। নইলে নিজের গায়েই টেররিস্ট তকমা লেগে যায়।
খাঁদুদের দোষ দিয়ে লাভ কী? প্রতিবেশী দেশের প্রোডাকশন লাইন থেকে যে উগ্রপন্থীরা বছরের পর বছর বেরিয়েছে, হয়ত এখনো বেরোচ্ছে, এ তো সত্যি কথা। কাশ্মীর-নামক মাছের কাঁটা আমাদের দু’দেশের গলায় আজন্ম আটকে থাকবে এটাও ঘটনা। খাঁদুদের কাছে তাই পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বলে কিছু হয় না। সবাই খুনী, সবাই ভারত-বিদ্বেষী। আমাদের মতন ছাপোষা সাধারণ নাগরিক একটি উগ্রপন্থী দেশেও থাকতে পারে্ নাকি? যুদ্ধ জিগীর জাগিয়ে রাখা দুই রাষ্ট্রের জন্য এই ধারণা, বা ধারণার অভাবটাই ভাল। তাই না?
ক্রিকেট মাঠের ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের ইন্ধন যুগিয়েছে আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডল এ কথা আমরা সবাই জানি। এটাই দস্তুর। ফুটবলে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা বা ইংল্যান্ড-জার্মানি, ক্রিকেটের অ্যাশেজে ইংল্যাণ্ড-অস্ট্রেলিয়া, এইসব চিরন্তন দ্বন্দ খেলার মাঠে সৃষ্টি হয়নি, বরং দুই দেশের সামরিক দ্বৈরথ বা সামাজিক কোন্দল খেলার মাঠের লড়াইকে বর্ণময় করেছে, আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
‘হ্যান্ড অফ গড’ ম্যাচের পর ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা তো বলেইছিলেন, ফকল্যান্ড যুদ্ধের বদলা নিলাম আজ।
একটা স্তর অব্দি যে কোন ক্রীড়ামোদীর জন্য এ ধরণের লড়াই আকর্ষণীয়। ৯৬-এর বিশ্বকাপে আমীর সোহেল যখন স্টেপ আউট করে কভার দিয়ে ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে বাউন্ডারিতে ছুঁড়ে ফেলেন এবং অঙ্গভঙ্গি করেন, এবং তারপরেই প্রসাদ তাঁকে ক্লিন বোল্ড করে সুদে আসলে সে অপমান ফিরিয়ে দেন, তখন আমরা স্বভাবতই দেশ-প্রেমে গর্জে উঠি। এটা স্বাভাবিক এবং খেলাধুলার নির্ভেজাল অঙ্গ, এ কথাও মিথ্যে নয়।
কিন্তু সমস্যা হয় যখন দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের মতন সাধারণ মানুষরাই কুৎসিত জায়গায় নিয়ে যাই। যখন পাকিস্তানের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি সৌজন্যের হাত বাড়িয়ে দেন বাবর আজম এবং মহাম্মদ রিজওয়ানের দিকে, তখন তাঁর দিকে ধেয়ে আসে তিরস্কার, অপমানের তীক্ষ্ণ বাণ, যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা, ভারতীয়রা, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের শিক্ষার অভাব নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ইয়ার্কি করি, যখন পাকিস্তানের নাগরিকরাও একই রকম রুচিহীন আক্রমণে মাতেন, তখন ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যায়। ইংরেজিতে এই ধরণের সম্পর্ককে ‘টক্সিক’ বলা হয়ে থাকে, আমরা না হয় বিষাক্তই বলি এখানে, যদিও টক্সিকের সম্পূর্ণ মানে তাতে ধরা পড়ে না।
এই মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটীয় সম্পর্ক আর সব সম্পর্কের মতই তলানিতে এসে ঠেকেছে, বরং তারও নিচে কোন অতল, বীভৎস পাতালে স্থান নিয়েছে। এই বিখ্যাত, বর্ণময় ক্রিকেট রাইভ্যালরি এককালে বহু সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিয়েছে আমাদের, দুই দলই সফর করেছে একে অপরের দেশে, বিশাল চাপ, মারকাটারি উত্তেজনা সহ্য করে দারুণ ক্রিকেট খেলেছেন দুই দেশের ক্রিকেটাররা। আমাদের দুই দেশের নাগরিকদের গর্বিত করেছেন। সে যুগ হয়ত আর আসবে না, উগ্র জাতীয়তাবাদের হাড়িকাঠে বলি হয়ে গেছে দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেটের মঞ্চ। খাঁদু বলবে, আগে ওরা বোমা বাঁধা বন্ধ করুক, কাশ্মীরে শয়তানি বন্ধ করুক, তারপর খেলার কথা ভাবা যাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতায় এখানে ঢুকব না, কিন্তু সংশয় হয়, দুই দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষ কি চান অন্য দেশটি শেষ হয়ে যাক? সাধারণ মানুষ দিয়েই তো দেশ হয়, তাই না?
ভারত-পাকিস্তান, ভারতীয় এবং পাকিস্তানিরা তেল-জলের মত, দুই আলাদা মেরুর মানুষ, এ কথা আমাদের রোজ বোঝানো হয় আজকাল, দুদিকেই। ধর্ম থেকে আচার-ব্যবহার সবটাই আলাদা, মিল হতে পারে না। কিন্তু সেই মিলটাই যে ঘটে গেল চোখের সামনে, বড্ড অনায়াসেই। এবং ঘটল সেই সুদূর ইংল্যান্ডে। কাউন্টি ক্রিকেট যেন সহজেই দেখিয়ে দিয়ে গেল, আমরা যতটা না আলাদা, তার থেকে অনেক বেশি এক, সংস্কৃতিতে এক, ভাগ-করে–নেওয়া ‘কমন’ ইতিহাসে এক, মায় ক্রিকেটীয় বোধেও প্রায় এক।
সাসেক্সের হয়ে যখন আমাদের চেতেস্বর পুজারা পাকিস্তানের মহম্মদ রিজওয়ানের সঙ্গে দারুণ যুগলবন্দিতে ১৪৫-রানের পার্টনারশিপ গড়ে তুলছেন, যখন একে অপরকে উৎসাহ দিচ্ছেন, তখন ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের বাইরে তাঁদের স্বাভাবিক সৌহার্দ্যের কথা ভাবায় বেশি। এও যদি সম্ভব হয় তাহলে কী কী মিথ্যে? খেলা তো প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি মিলনের বার্তাও দেয়, কিন্তু সেই বার্তা আমরা ভুলে গেছি। আইপিএল, পিএসএল-এর মাটি সে বার্তা বয়ে আনতে পারেনি, এনেছে বহু দুরের এক দেশের মাটি, যে দেশ এক-কালে আমাদের দুই দেশেই রাজ্যপাট বসিয়ে ছিল। এটাই তো ক্রিকেট, তাই না? যে মিলগুলো আমরা ভুলতে বসেছি সেগুলোই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিইয়ে গেল সে।
ভাবছি খাঁদুকে বলব পাটিয়ালা ঘরানার নবাব, পাকিস্তানের উস্তাদ আমানত আলী খাঁর খেয়াল শুনতে। “ভারতীয়’ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহু বিখ্যাত উপাসক যে ওপারের মানুষ, এ কথা কি ও জানে?