তিরিশ বছর পর স্মৃতিতে ‘বেনোজল’ ও ঝুলনদের বৃষ্টিবিঘ্ন 

বেনোজলে ভেসে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনাল-স্বপ্ন। সবে তিরিশ বছর পেরল সেই ২২ মার্চ ১৯৯২-এর। তার দু-দিনের মধ্যেই এবার বৃষ্টির জলে ভেসে মেয়েদের পঞ্চাশ-ওভারের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছল দক্ষিণ আফ্রিকা! সিডনি থেকে গুগলমতে ২,২২৫ কিলোমিটার দূরের ওয়েলিংটনে।

একই সঙ্গে, ঝুলন গোস্বামী-মিতালি রাজদের বিশ্বকাপের সেরা-চারে থাকার সম্ভাবনায়ও জল ঢেলে দিল বৃষ্টি! পরিস্থিতি এখন এমন, শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জিততে হবে অথবা খেলা পরিত্যক্ত হতে হবে। হারলে বিদায় ঝুলনদের। আর, এই পঞ্চাশ-ওভারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়েরা যেমন খেলছেন, তাঁদের হারানো কঠিন তো বটেই।

তিরিশ বছর আগে এভাবেই বৃষ্টি জল ঢেলে দিয়েছিল ভারতের আশায়। কীভাবে? বিশ্বকাপের ইতিহাসে চোখ ফেরানো যাক।

শচীন তেন্ডুলকারের প্রথম বিশ্বেকাপে সেই ম্যাচে আয়োজক অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ৫০ ওভারে তুলেছিল মাত্র ২৩৭ রান, ৯ উইকেটে। দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন কপিলদেব। ৪১ রানে তিন উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি দুটি মেডেন ওভারও ছিল যেমন, আর একটি ওভারে রান দিয়েছিলেন মাত্র দুই। কে জানত তখন, এত ভাল বল করেই দলের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন কপিলদেব!

ভারতীয় ইনিংসের মাঝপথে বৃষ্টি নেমেছিল। খেলা বন্ধ প্রায় মিনিট দশেক। সেই বিশ্বকাপের নিয়ম অনুযায়ী, তিন ওভার কাটা গিয়েছিল ভারতের। আর রিচি বেনোর নিয়মে বাদ গিয়েছিল সবচেয়ে কম রান দেওয়া কপিলের সেই তিনটি ওভার। অর্থাৎ ১৮ বল কমে গিয়ে জয়ের লক্ষ্য থেকে কমেছিল মাত্র দু-রান!

নিয়মটা বিশদে জানানো জরুরি। বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটি রিচি বেনোর হাতে দিয়েছিল বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে পরে ব্যাট-করতে যাওয়া দলের রানের লক্ষ্য ঠিক করার ভার। বেনোর বিধান, প্রথমে ব্যাট-করা দল যে-ওভারগুলোতে সবচেয়ে কম রান তুলতে পেরেছে সেগুলোই বাদ যাবে।

এই অদ্ভুত ভাবনার প্রতিবাদ কেউ করেননি তখন। মেনে নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল সব দল। মুশকিলটা হ’ল, এই ভাবনায় একদিনের ক্রিকেটে ফিল্ডিংরত দলের পক্ষে যা সবচেয়ে দামী, সেই মেডেন ওভারই পরে ব্যাট করতে নামার সময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অভিশাপ!

মানে, কপিল যদি সেই দিন দুটো মেডেন না নিয়ে একটি করেও রান দিতেন এবং তৃতীয় আরও একটি ওভারে দু-রান দিতেন, ভারতের তিন ওভার কমলে তখন জয়ের লক্ষ্য দাঁড়াত ২৩৪। কিন্তু তা না হওয়ায় জিততে হলে ভারতকে ২৩৬ করতে হত আর ভারত থেমেছিল ২৩৪ রানে। শেষ বলে তৃতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়েছিলেন বেঙ্কটপতি রাজু। ওই তৃতীয় রানটা হলেও টাই হত ম্যাচ।

ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, পরে ব্যাট করতে নামার পর বৃষ্টি এলেই আতঙ্কে থাকতেন বোলাররা, ‘এই রে, আমি তো একটা মেডেন নিয়েছি, একটায় এক রান দিয়েছি, দু-ওভার বাদ গেলে তো আমার জন্যই বিপাকে পড়বে দল’!

এমন নিয়ম যা ভাল ক্রিকেটের পরিপন্থী। বোলারকে ভাল বোলিং করতে নিরুৎসাহিত করে, ভাল বোলিং প্রাপ্য মূল্য পায় না। সমস্যা আরও, কারণ নিয়মটা এমন একজন ভেবেছিলেন যাঁর ক্রিকেট-প্রজ্ঞা নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলার সাহস দেখাতে পারেননি। সত্যিই তো, রিচি বেনোর ক্রিকেট-ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়?

কিন্তু সেই নিয়মের কারণেই ভারত সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছতে পারেনি যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকাও যেতে পারেনি ফাইনালে।

সেই বৃষ্টি এসেছিল, সেই দু-ওভার কমেছিল, সেই দুটি মেডেন ওভার যা নিয়েছিলেন মেরিক প্রিঙ্গল! তাই ১৩ বলে ২২ থেকে ১ বলে ২২ রান তোলার অসম্ভব এবং অবাস্তব লক্ষ্যের সামনে সদ্য আন্তর্জতিক ক্রিকেটে ফিরে-আসা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের কান্না সিডনিতে, আর ক্রিকেট-ইতিহাসে চিরকাল থেকে-যাওয়া সিডনি স্কোরবোর্ডের সেই ছবি যা বলেছিল, ১ বলে ২২ রান দরকার জিততে।

প্রয়াণের সাত বছর পর আপনাকে এই কারণেই মনে পড়বে, সত্যিই ভাবা যায়নি, রিচি বেনো।