২০১২-১৩ মরশুম। ড্যারেন সামির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খুলনা টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,০৬০) অভিষেক ঘটে ডানহাতি পেসার আবুল হাসানের। টসে জিতে মুশফিকুর রহিম প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নতুন বল হাতে পাওয়ার আগেই অন্য ভূমিকায় মাঠে নেমে পড়তে হয় হাসানকে। এবং ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে ছুঁয়ে ফেলেন অভিষেক টেস্টে দশে ব্যাট করতে নেমে শতরানের শতাব্দীপ্রাচীন নজিরকে। সুদূর ১৯০১-০২ মরশুমে আর্চি ম্যাকলারেনের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৬) যা স্থাপন করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রেজিনাল্ড ডাফ। প্রসঙ্গত, খুলনায় ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে করা হাসানের সেদিনের ১১৩ ছিল আজ অবধি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর খেলা একমাত্র তিন অঙ্কের ইনিংস। যদিও বল হাতে বিশেষ দাগ কাটতে না পারায় তৃতীয় টেস্টের পর ৮২.৫০ গড়েই থেমে যেতে হয় তাঁকে।
আসি ভারতীয়দের কথায়। ঘটনা হল কোয়ালিফিকেশনের নিরিখে মান্য তালিকায় ঠাঁই পাওয়া কোনও ভারতীয় ব্যাটারের গড়ই আজ অবধি স্পর্শ করতে পারেনি ষাটের দাগ। এবং ভারতীয় হিসেবে উক্ত তালিকায় সবার উপরে অবস্থান করছেন নিজের প্রতিভার প্রতি কখনও সুবিচার না করতে পারা বিনোদ কাম্বলি (৫৪.২০)। টেস্ট ক্রিকেটের আসরে তিন চিরশ্রেষ্ঠ ভারতীয় ব্যাটার সুনীল গাভাসকার (৫১.১২), শচীন তেন্ডুলকর (৫৩.৭৮) ও রাহুল দ্রাবিড়ের (৫২.৩১) স্থান তাঁর পিছনেই। যদিও দ্রাবিড়ের গড়ে অন্তর্ভুক্ত আছে আইসিসি বিশ্ব একাদশের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৫-০৬ সিডনি টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১,৭৬৮) ব্যাট করা দু’টি ইনিংসের খতিয়ানও। যাক, মান্য তালিকার বাইরে অবস্থানরত তিন ভারতীয় ব্যাটার আজ অবধি পৌঁছতে পেরেছেন ব্র্যাডম্যানের গ্রহে। কালানুক্রমে যাঁরা হলেন দীপক শোধন (গড় ৬০.৩৩), করুণ নায়ার (গড় ৬২.৩৩) ও ওয়াশিংটন সুন্দর (গড় ৬৬.২৫)।
১৯৫২-৫৩ মরশুম। অকুস্থল কলকাতা। চলছিল ইতিহাসের প্রথম ভারত-পাক সিরিজের পঞ্চম তথা অন্তিম টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩৬০)। কেউ জানত না দেশের হয়ে সেই শেষ টেস্ট খেলে ফেলছিলেন অভিষেকেই শতরানের নজির গড়া প্রথম ভারতীয় পুরুষ লালা অমরনাথ। ঘটনাচক্রের অদ্ভুত যোগাযোগ কিন্তু প্রথমের বিসর্জন মঞ্চেই লিখে রেখেছিল দ্বিতীয়র আবির্ভাবের চিত্রনাট্য। আরও লক্ষণীয়, দলীয় ১৭৯ স্কোরে ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে অমরনাথের পতনের পরই ক্রিজে আসা দীপক শোধনের। দ্বিতীয় ভারতীয় পুরুষ হিসেবে আবির্ভাবেই শতরানের (১১০) নজিরই অতঃপর গড়েননি এই গুজরাতি ন্যাটা অলরাউন্ডার, দলীয় সংগ্রহকেও নিয়ে গিয়েছিলেন ৩৯৭-এর নিরাপদ ঠিকানায়। ইতিহাসের ধুলো ঝাড়তে বসলে আজ আশ্চর্য লাগে এমন মানুষের কেরিয়ারকে মাত্র তৃতীয় টেস্টের পরপরই থেমে যেতে দেখে।
২০১৬-১৭ মরশুম। অকুস্থল চেন্নাই। পাঁচদিনের ক্রিকেটের আসরে বীরেন্দ্র শেহবাগের পর ভারতবর্ষের মাত্র দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরিয়নকে কে ভুলতে পেরেছে এত শিগগির! করুণ নায়ারের অপরাজিত ৩০৩-এর দৌলতে অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডকে সেই টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,২৪১) ইনিংস ও ৭৫ রানে পরাস্ত করেছিল বিরাট কোহলির ভারত। তবে ওই ইনিংসটি ব্যতিরেকে টেস্ট ক্রিকেটের আসরে আর তেমন কিছুই করতে না পারায় (এবং ঘরোয়া স্তরেও খেলা পড়ে যাওয়ায়) নায়ারের কেরিয়ার আটকে আছে ষষ্ঠ টেস্টের পরপরই।
২০২০-২১ মরশুম। ভাঙাচোরা দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার দুর্গ হিসেবে চিহ্নিত ব্রিসবেন থেকে অজিঙ্ক রাহানের ভারতের টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,৪০৪) তথা সিরিজ জিতে আসার স্মৃতি এখনও টাটকা দেশীয় ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৬৯-এর জবাবে প্রথম ইনিংসের একটা পর্যায়ে ১৮৬/৬ হয়ে যাওয়া দলকে ১২৩ রান জুড়ে লড়াইতে ফিরিয়েছিল ওয়াশিংটন সুন্দর ও শার্দূল ঠাকুরের সপ্তম উইকেট জুটি। যথাক্রমে জীবনের প্রথম ও দ্বিতীয় টেস্ট ইনিংসে নেমেছিলেন যাঁরা সেদিন ব্যাট হাতে।
ক্রিকেট একার খেলা নয়। ইটের পর ইট সাজিয়ে ইমারতকে আকাশের ঠিকানায় তুলে নিয়ে যেতে খোদ ব্র্যাডম্যানেরও দরকার হয় একজন সঙ্গীর। রাজা ভোজদের দিন ফুরিয়ে এলে সাজঘর থেকে তাই বেরিয়ে আসতে হয় অন্তত কোনও গাঙ্গু তেলিকেও। সেই রসদও ফুরিয়ে গেলে? ব্রিসবেনে শার্দূলকে সঙ্গে পেয়েছিলেন ওয়াশিংটন। চতুর্থ তথা আজ অবধি খেলা শেষ টেস্টে আমেদাবাদে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,৪১৪) স্নায়ুর রাশ ধরে রাখতে রাখতে নন স্ট্রাইকার প্রান্তে পুরনো সঙ্গীকেই কি খুঁজছিল না সেদিন তাঁর অন্তরাত্মা! জো রুটের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেদিন ব্যাট হাতে নামার আগে অবধি টেস্টে ওয়াশিংটনের ব্যাটিং গড় ছিল ৪২.২৫। নিঃসন্দেহেই সেদিন অপরাজিত থাকার ঘটনাই পৌঁছে দিয়েছিল তাঁকে ব্র্যাডম্যানের গ্রহে। তবে সঙ্গীর অভাবে জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান থেকে চার দাগ আগেই থেমে।
খোদ ব্র্যাডম্যানের পড়শিও কি এভাবে হতে চাইতেন পৃথিবীর কোনও মানুষই!
(সমাপ্ত)