আজ থেকে বোধহয় বছর কুড়ি-বাইশ আগেকার কথা, শন পোলক তখন তাঁর খ্যাতির তুঙ্গে। নাটালের নর্থউড বয়েজ হাই স্কুলের বছর দশ-বারোর এক ছোট ছেলে [তার বাবা বর্ণবিদ্বেষী বিভাজনের আমলে তাঁর রাজ্যের ‘বি’ টিমের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন] হয়ত তার স্কুলের সেই বিখ্যাত প্রাক্তনীর মতই পেস-বোলার হওয়ার বাসনায় জোরে বোলিং অভ্যাস করত। কিন্তু পোলকের মতন পেসার হওয়া তার বরাতে ছিলনা, তাই স্কুলের নেটে খেয়ালের বশে এক বিকেলে সে স্পিন বোলিং করে দেখল, আর দেখল যে তাতে বেশ ভালই কাজ হচ্ছে। ব্যস, তার accuracy অস্ত্রকে প্রধান হাতিয়ার বানাতে সে মন দিল স্পিনার হওয়ার সাধনায়। ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ, বেশ কয়েক মরশুম দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে স্পিনাররাই ছিলেন উইকেট-শিকারীদের তালিকায় ওপরের দিকে। ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ মরশুমে তাঁদের মধ্যে ঢুকে পড়লেন (হ্যাঁ, সেই ছেলেটা তখন বছর চব্বিশ-পঁচিশের) তরুণ বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিন-বোলার কেশব মহারাজ। ততদিনে accuracy-র সঙ্গে সঙ্গে তিনি রপ্ত করে ফেলেছেন ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উইকেট নেওয়ার ক্ষমতাটাও।
২০১৬-১৭ মরশুমের প্রথম প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ১৫৭ রানে ১৩টা উইকেট দখল করে পরের মরশুমে কেশব ডাক পেলেন অস্ট্রেলিয়া-সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক দলে। সেই সফরে ২০১৬ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁর টেস্ট-অভিষেক হ’ল (কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবেই) পার্থের ওয়াকা-তে, যা পেসারদের প্রিয় বিচরণভূমি হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু কেশব হাল ছাড়বার পাত্র নয় – ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে (দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে ব্যাটিং নেয়) ডেল স্টেন চোট পেলেও বাকি দুই পেসার কাগিসো রাবাডা ও ভার্নন ফিল্যান্ডারকে উইকেটের এক প্রান্ত থেকে ‘রোটেট’ করাতে সাহায্য করে অন্য প্রান্ত ধরে রাখলেন তিনি (১৮.২-৫-৫৬-৩), নিলেন স্টিভ স্মিথ, মিচেল স্টার্ক ও পিটার নেভিল-এর উইকেট। তার আগে ব্যাট হাতে কুইন্টন ডি’কক-এর সঙ্গে ৮ম উইকেটে ৭.৩ ওভারে মূল্যবান মারমুখী ৪৮ রানের (১৭৫-৭ থেকে ২২৩-৮) জুটি গড়েন – নিজে করলেন ১৬ রান, স্টার্ক-হ্যাজলউড-সিডল-লিয়ঁ এঁদের বিরুদ্ধে। ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে আবার সাফল্য, ফিল্যান্ডার-এর সঙ্গে ৮ম উইকেটে ১৪ ওভারে ৭২ রানের (৪৬৮-৭ থেকে ৫৪০-৮) জুটি – নিজে করলেন ৪১* আর ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে বিপক্ষকে চাপে রেখে (৪০.১-১০-৯৪-১) ম্যাচ শেষ করলেন নাথান লিয়ঁ-র উইকেট নিয়ে, দল জিতল ১৭৭ রানে। বোঝা গেল টেস্ট-ক্রিকেটে টিঁকে থাকবার মসলা আছে কেশবের মধ্যে, আর টিঁকে তিনি থাকলেনও। শুধু টিঁকেই থাকলেন না, ধীরে ধীরে নিজের একটা জায়গাও তৈরি করলেন।
এবার এক লাফে আমরা পেরিয়ে যাই প্রায় সাড়ে-পাঁচ বছর, চলে আসি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। ৪২টা টেস্ট খেলে আজ কেশব নিয়েছেন ১৫০টা উইকেট, গড় ৩০.৬৭, সেরা বোলিং ১২৯ রানে ৯ উইকেট, ম্যাচে-দশ-উইকেট একবার ও ইনিংসে-পাঁচ-উইকেট ন’বার। সঙ্গের ছবিটাই বলে দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট-দুনিয়ায় তাঁর অবস্থান – পল অ্যাডামস-কে (১৩৪) পেছনে ফেলে তিনি এখন ধাবমান হিউ টেফিল্ড-এর (১৭০) পেছনে।
কেশবের আরও গোটা-দুয়েক বোলিং-কৃতিত্বের কথা বলি:
- পরপর দুটো টেস্টে ইনিংসে-সাত-উইকেট নেওয়ার ব্যাপারে তিনি দশম (২০২২), তাঁর পূর্বসুরীদের তালিকায় আছেন জর্জ লোহম্যান (১৮৯৫-৯৬), টিচ ফ্রিম্যান (১৯২৯), ক্ল্যারি গ্রিমেট (১৯৩৫-৩৬), অ্যালেক বেডসার (১৯৪৬), হিউ টেফিল্ড (১৯৫৬-৫৭), টনি লক (১৯৫৮), ইমরান খান (১৯৮২), আব্দুল কাদির (১৯৮৭), ওয়াকার ইউনিস (১৯৯০-৯১) ও হরভজন সিং (২০০১)।
- ২০০২ সাল থেকে শুরু করে, টেস্টের এক ইনিংসে সবচেয়ে কম বল ডেলিভারি করে সাতটা উইকেট নেওয়ার ব্যাপারে তিনি দ্বিতীয় (৫৩ বলে), তাঁর থেকে এই ব্যাপারে এগিয়ে আছেন একমাত্র স্টিউয়ার্ট ব্রড (৪২ বলে)।
কেশবের এই সাফল্যের সূত্র ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের একটি বৃহত্তর প্রসঙ্গ একটু ছুঁয়ে দেখা যাক। সুদীর্ঘ ৫২ বছর পরে [শেষবার ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চার-ম্যাচের ১৯৭০ টেস্ট-সিরিজে কেপ-টাউনের প্রথম ম্যাচে – অফ-স্পিনার কেলী সেমুর ও বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার গ্রাহাম শেভালিয়ের] দেশের মাটিতে কোনও টেস্ট-ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা দুজন স্পিনার খেলিয়েছে – বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক এই দু’ম্যাচের ২০২২ টেস্ট-সিরিজে – কেশব মহারাজ ও ডান-হাতি অফ-স্পিনার সাইমন হার্মার, যিনি ২০১৫ সালে পাঁচটা টেস্ট খেলবার পর এতোদিন বাদে আবার টেস্ট দলে এলেন। এই দু’জন মিলে এই সিরিজে মোট ২৯টা উইকেট নিয়েছেন – মহারাজ ১৬টা ও হার্মার ১৩টা। এ কি এক ‘নতুন’ দক্ষিণ আফ্রিকা?
তার মানে কি এই যে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং-আক্রমণ তার প্রথাগত চিরাচরিত পেস-নির্ভরতা কমিয়ে স্পিন-নির্ভরতার দিকে ঝুঁকতে চলেছে? উত্তরটা শোনা যাক তাদের টেস্ট-অধিনায়ক ডীন এলগার-এর মারফৎ। দুই স্পিনারের সাফল্যের চাবিকাঠি কিন্তু ছিল discipline – চরকি-মার্কা স্পিন নয় – ধৈর্য ধরে ঠিক জায়গামতন বল ফেলে যাওয়া। দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনের বিকেলে কম আলোয় ধীরগতির উইকেটে – ঘূর্ণি পিচে নয় – দুই স্পিনারকে দিয়ে চতুর্থ ইনিংসের আক্রমণ শুরু করা নিয়ে এলগার বলেন: “How awesome was it to see two spin bowlers bowling in tandem and have it on a string and absolutely dominate the opposition. It was great to see both of them competing at such a high level. Most batting line-ups would have had a tough ask against them. The pure skill level and intensity they brought along with their consistency was amazing to witness.“
দক্ষিণ আফ্রিকা কি আবার দুই স্পিনারে খেলবে? সম্ভাবনা কম, বিশেষত আইপিএল-অন্তে কাগিসো রাবাডা, লুঙ্গি এনগিডি,মার্কো ইয়ানসেন ও আনরিখ নর্টিয়ে এঁদেরকে আবার জাতীয় দলের জন্য পাওয়া গেলে। এই নিয়ে এলগার বেশ দ্বিধাহীন: “It’s not the style of cricket we are generally used to or want to play. We still want to play Highveld cricket where you are playing three seamers, an all-rounder and a world-class spinner and have that style where fast bowling is our prime source of attack.“
এলগার অবশ্যই দলের এই adaptability-তে খুশি: “It shows a lot of character with regards to adapting and being put in conditions we are not familiar with. It also shows a lot of strength within our group that we have the resources to adapt.” তাঁর আশা যে এই ‘অন্যরকম’ অভিজ্ঞতা তাঁর দলকে উপমহাদেশীয় উইকেটে খেলতে আরো বেশি সহায়তা করবে: “We play quite a lot of cricket in the sub(-continent). It was great to expose our bowling attack to having two spinners operating in tandem. There’s so many positives out of that.”
দেখা যাক অনতিদূর ভবিষ্যতে এই ‘প্রোটিয়া-মহারাজ’ উপমহাদেশের মাটিতে স্পিন-খেলতে-নিয়মিত-অভ্যস্ত ব্যাটারদের তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেন কিনা!