যিনি বলেছিলেন তিনি পল দো পল কা শায়র, যিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিলেন মাত্র ৩২ বছর বয়েসে, যিনি নিঃশব্দেই ওডিআই প্রাঙ্গন ছেড়েছেন যদিও সময়ের কিছুটা পরে, তাঁর এবার আইপিএল খেলার কি খুব প্রয়োজন ছিল?
এতক্ষণে নিশ্চয় আপনারা বুঝতে পেরে গেছেন আমি কার কথা বলছি। মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কেউ পছন্দ করেন, কেউ তাঁকে ভগবান মনে করেন, কারুর-কারুর কাছে তিনি আবার চোখের বালি সমান, কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের আধুনিক যুগের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে যে তিনি অন্যতম, এ কথা অনস্বীকার্য।
![](https://willowrwill.files.wordpress.com/2022/04/a8ed5e8d-916b-42e8-a01e-70c42cb9da2e.webp?w=1024)
ধোনি শুধু সফল ক্রিকেটার নন, তিনি বহু বছর ধরে তাঁর একটা ইমেজও তৈরি করেছেন মাঠে এবং মাঠের বাইরে। ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড অনেক ভেবে-চিন্তে চলে বা চালানো হয় এ কথা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় না।
কেরিয়ার চলাকালীন আর কোন ক্রিকেটারের বায়োপিক হয়েছে? এবং সে বায়োপিক বানানো হয়েছে তাঁরই অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে। যার ফলে যে ছবিটি আমরা পেয়েছি তাকে ইংরেজিতে হেজিওগ্র্যাফি বলা হয়ে থাকে [“Hagiography” is a biography that treats its subject with undue reverence.]। ধোনির অবিশ্বাস্য উত্থানের গল্প সুন্দর ভাবে তুলে ধরলেও সে সিনেমায় তাঁকে কোথাও নিদাগ নিষ্কলঙ্ক মহাপুরুষ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল।
এহেন ধোনি কী করছেন ক্রিকেট জীবনের শেষ লগ্নে এসে? কেন খেলছেন তিনি ২০২২-এর আইপিএল? জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত তিনি হয়ে গেছেন বহুদিন আগেই। অধিনায়ক হিসেবে সাদা-বলের ক্রিকেটে অভূতপূর্ব সাফল্য তো রয়েছেই, তার সঙ্গে সৃষ্ট হয়েছে সযত্নে লালিত ধোনি ইমেজ। এক-মাথা লম্বা চুল সম্বিলিত তরুণ, দৃপ্ত উইকেটকিপার ধীরে-ধীরে হয়ে উঠেছেন ঠান্ডা মাথার, দার্শনিক সুলভ মহা-ক্যাপ্টেন, এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি মাঠের সাফল্য-ব্যর্থতায় প্রভাবিত হন না। জীবনের মানে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে লুকিয়ে নেই এই কথাটা তিনি যেন জানেন। মাঠের বাইরে অবশ্য ধোনি সুচারু ভাবে গড়ে তুলেছেন তাঁর সাম্রাজ্য। তাতে ভুলও কিছু নেই, ক্রিকেট মহাতারকারা তাঁদের মাঠের সাফল্য ব্যবহার করবেন বাইরের পৃথিবীতে এতে আশ্চর্যের কী আছে। এর মধ্যেই রীতি স্পোর্টস-কান্ড জাতীয় কিছু বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছে, যা ধোনি হেলিকপ্টার শট মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সহজেই। আমরাও তা ভুলে মেরে দিয়েছি।
কিন্তু এই ধোনিস্ফিয়ার আস্তে-আস্তে তার প্রভাব হারিয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। ২০১৯-এর বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে তিনি প্রায় অসাধ্যসাধন করে দিয়েছিলেন। পরিচিত স্ট্র্যাটেজিতে আস্তে শুরু করে দলকে ফিনিশ লাইনের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন রান-আউট হয়ে যাওয়ার পর এমএসডির মুখে যে যন্ত্রণা আমরা দেখেছিলাম তা তাঁর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব।
কিন্তু গুঞ্জন তার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তিনি জায়গা আঁকড়ে বসে আছেন, তাঁর ফিনিশিং ইন্সটিঙ্কট শেষ হয়ে গেছে, ইত্যাদি।
ধোনি aura-তে কালি লেগে গেছিল সেদিনই।
কিন্তু তিনি যে এমএসডি, আর ৫টা গড়পড়তা ক্রিকেটার নন, তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ২০২১-এর আইপিএলএ। ক্যাপ্টেন কুল যখন সে বছরের ট্রফি হাতে পোজ দিচ্ছিলেন, আমার অন্তত মনে হয়েছিল এটাই তাঁর খেলা থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আদর্শ সময়।
ভেবেছিলাম ক’দিন পর পৃথিবী শান্ত হওয়ার পর তিনি টুক করে একটা টুইট করে জানিয়ে দেবেন যে এবার সম্পূর্ণ ভাবে দ্বিতীয় ইনিংসে মনোনিবেশ করছেন তিনি।
![](https://willowrwill.files.wordpress.com/2022/04/ad0d5e7f-1d17-441d-ab99-240dc36f0fe5.webp?w=1024)
কিন্তু তা হয়নি। বরং ২০২২-এর আইপিএল-এ আবার নামলেন চেন্নাই সুপার কিংসের প্রিয় ‘থালা’। এবং অধিনায়কত্বর বেটন দিয়ে দিলেন রবীন্দ্র জাদেজার হাতে। সবটাতেই একটা ধোনিসুলভ চমক ছিল বটে, কিন্তু ছন্দপতন ঘটতে শুরু করল, এবং ঘটতেই থাকল। পর-পর চারটে হারের পর ধোনি-জাদেজার ধুঁকতে থাকা সিএসকে প্লে-অফে যেতে পারবে কি না সেই নিয়েই বিশাল প্রশ্নচিহ্ন খাড়া হয়েছে, যদিও এখনও অনেকগুলি খেলা বাকি।
কিন্তু ধোনি কেন তাঁর রূপকথাসুলভ ক্রিকেট জীবনের শেষ লগ্নে এরকম একটি অকারণ ঝুঁকি নিলেন? আইপিএল কোন ভাবেই একটি আন্তর্জাতিক আইসিসি ট্রফি জেতার সমতুল্য নয়, কিন্তু সে সুযোগ তো তাঁর জীবনে আর আসবে না, সে ক্ষেত্রে আগের বছর আইপিএলের জেতাই কি তাঁর ক্রিকেট জীবনের শ্রেষ্ঠ সমাপ্তি হিসেবে গণ্য হত না? কী এমন মোহ রয়েছে আইপিএলের? নিশ্চয় কেবল টাকার জন্য তিনি খেলছেন না ২০২২-এর আইপিএলে?
![](https://willowrwill.files.wordpress.com/2022/04/faa0da5d-02f2-4a37-a5c3-fa7627ec8c3b.webp?w=1024)
হয়ত ধোনি সিএসকে-কে এতটাই ভালবাসেন যে তিনি জাদেজাকে ক্যাপ্টেন হিসেবে তৈরি করতে তাঁর সঙ্গে এ বছর আইপিএল-টা খেলে দিচ্ছেন, হয়ত সিএসকে-র কর্মকর্তারাই তাঁকে এই অনুরোধ করেছেন। কারণটা যাই হোক, এরকম একটি বর্ণময় ক্রিকেট জীবন যদি আইপিএল ব্যর্থতার মাধ্যমে শেষ হয় তাহলে অগণিত ক্রিকেট এবং ধোনি-ভক্ত যে ব্যথিত হবেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত হেরে গেলেও তাঁর মুখের পরিচিত স্মিত হাসি অক্ষুণ্ণ থাকবে, হয়ত আবার একটা বিশাল টুইস্ট অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য এই আইপিএল এবং ধোনি আখ্যানের একদম শেষ অধ্যায়ে। কিন্তু এই ঝুঁকিটা নেওয়ার কি দরকার ছিল? ভুল বললাম, এই ঝুঁকিটা নেওয়ার কী দরকার ছিল?