পাওয়া-না-পাওয়ার খেলা: হঠাৎ কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায়না!

সিডনিতে ১৯৯৮-৯৯ মরশুমের পাঁচ-টেস্টের অ্যাশেজ সিরিজের পঞ্চম-তথা-শেষ টেস্ট। মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে ২-১ ম্যাচে, শেষ ম্যাচে জিতে সম্মান বজায় রাখতে তাই মরিয়া অ্যালেক স্টিউয়ার্টের ইংল্যান্ড। বিশেষ ক’রে দিনকয়েক আগেই মেলবোর্নে চতুর্থ টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ডীন হেডলির বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৭৫ রান তাড়া করতে-নামা অজিদের শেষ সাতটা উইকেট মাত্রই ৬০ রানের মধ্যে দখল ক’রে ১২ রানে ম্যাচটা জিতে নেওয়ার বাড়তি উদ্দীপনায় ভর দিয়ে।

৪ঠা জানুয়ারি, ১৯৯৯ – ম্যাচের তৃতীয় দিন অস্ট্রেলিয়ার অসমাপ্ত দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু হ’ল ১১৫ রানে এগিয়ে থেকে, হাতে সবক’টা উইকেট – চমৎকার অবস্থা। কিন্তু বাদ সাধলেন ইংরেজ বোলাররা – পেসার ড্যারেন গফ ও ডীন হেডলি এবং সাড়ে-চার বছর বাদে দলে-ফেরা অল্পখ্যাত ডান-হাতি অফ-স্পিনার পিটার সাচ – লাঞ্চে অজিরা ৭৪-৪, ফিরে গেছেন টেলর, ল্যাঙ্গার, মার্ক ওয় ও লেহম্যান, চা-বিরতিতে ১৭৮-৭, ইনিংসের শেষ ৬৪.৫ ওভারে ১৮৪-তে – সাচ ৫-৮১, হেডলি ৪-৪০, গফ ১-৫১ এঁদের মিলিত প্রয়াসের ফসল। কিন্তু এরই ফাঁকে অল্পের জন্য অধরা রয়ে গেল একটা টেস্ট-রেকর্ড যা করা হয়েছিল ক্রিকেট-দুনিয়ার সর্বপ্রথম টেস্টে ১৮৭৭ সালে মেলবোর্নে, করেছিলেন চার্লস ব্যানারম্যান – দলের মোট ২৪৫ রানের মধ্যে ১৬৫*, ৬৭.৩৫ শতাংশ রান তুলে, যা এই ব্যাপারে আজ ১৪৫ বছর বাদেও সর্বোচ্চ। সিডনিতে এই ম্যাচে দলের মোট ১৮৪ রানের মধ্যে ১২৩ (২৭১ মিনিট, ১৮৯ বল, ১১x৪, ৩x৬) – ৬৬.৮৫ শতাংশ – করেন ডান-হাতি অজি ওপেনার মাইকেল স্ল্যাটার – আর একটা রান বেশি করলেই (তৎকালীন) প্রায় ১২৩ বছরের পুরোনো ঐ রেকর্ডটা যিনি ভেঙ্গে দিতে পারতেন। স্ল্যাটার তা পারেননি, তবে দল ম্যাচ জিতেছিল ৯৮ রানে, এবং সিরিজ, ৩-১ ম্যাচে। ঐটাই তো আসল, তাই না!

ছবি : ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

১৯৯৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজে ম্যাঞ্চেস্টারে টেস্ট-অভিষেক হওয়া স্ল্যাটারের টেস্ট-ব্যাটিং পরিসংখ্যান ভালই – ৭৪ ম্যাচে ৫,৩১২ রান (সর্বোচ্চ ২১৯), গড় ৪২.৮৩, ২১টা অর্ধশতরান আর ১৪টা শতরান, যেটা হতে পারত ২৩টা, কারণ তাঁর ১৩১ টেস্ট ইনিংসে তিনি মোট ন’বার নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন (৯১ দু’বার, ৯২, ৯৫, ৯৬ তিনবার, ৯৭, ৯৯) – এই ব্যাপারে তাঁর থেকে এগিয়ে আছেন কেবলমাত্র তিনজন – স্টিভ ওয় (২৬০ ইনিংসে ১০ বার), রাহুল দ্রাবিড় (২৮৬-তে ১০) ও শচীন তেন্ডুলকর (৩২৯-এ ১০) – তবে স্ল্যাটার এঁদের সবার থেকেই অনেক কমসংখ্যক ইনিংস খেলেছেন, তাই এই ‘না-পাওয়ার দুঃখ’ হয়ত তাঁরই খানিকটা বেশি!

এই ন’বার তিনি আউট হয়ছেন ছ’টি বিভিন্ন প্রতিপক্ষের বিরু্দ্ধে – ভারত দু’বার, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান দু’বার, দক্ষিণ আফ্রিকা দু’বার, শ্রীলঙ্কা, ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লক্ষণীয় এই যে ঐতিহ্যগত প্রাচীনতম ও বৃহত্তম প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড এই তালিকায় নেই! তাঁর এই ‘না-পাওয়ার ঘটনা’-র সাক্ষী আটটি বিভিন্ন শহরের ক্রিকেট-মাঠ – ব্যাঙ্গালোর, ডারবান, গল, হোবার্ট, করাচি, মেলবোর্ন, পার্থ, ও (তাঁর ঘরের শহর) সিডনি দু’বার।

৯৫ পেরিয়ে তাঁর পাঁচবার আউটের রকমসকম একঝলক দেখা যাক:

  • দু’বার উইকেট ছেড়ে তেড়ে মারতে বেরিয়ে গিয়ে স্টাম্পড – দু’বারই ৯৬-তে
  • লেগ-ব্রেকে ইনসাইড-আউট লফ্টেড ড্রাইভ করতে গিয়ে এক্সট্রা-কভারের হাতে ক্যাচ – আরেকটা ৯৬-তে
  • লেগ-স্টাম্পের ফুল-টস বল তুলে মারতে গিয়ে স্কোয়্যার-লেগে লোপ্পা ক্যাচ – ৯৭-তে
  • লেগ-গ্ল্যান্স করতে গিয়ে মৃদু খোঁচা – ৯৯-তে
ছবি ইন্টারনেট থেকে

এই প্রসঙ্গে স্ল্যাটারের আত্মজীবনী থেকে তাঁর নিজের জবানিতে একটা কথা উল্লেখ করি: “I was a passionate player who, for better or worse, wore his heart right out there on his sleeve … I played the game the only way I knew how: full on.” সঙ্গে উদ্ধৃত করি তাঁর সম্বন্ধে ESPN Cric Info থেকে পাওয়া এই বাক্যটি: “A combative and whole-hearted cricketer, Michael Slater has played many vital innings for New South Wales and as an Australia opener with his adventurous brand of stroke-play.” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবেই তাঁর এই আগ্রাসী আক্রমণাত্মক মনোভাবের প্রতিফলন কিন্তু তাঁর ওডিআই-জীবনে  দেখা যায়নি, অভিষেকেই মেলবোর্নে দক্ষিণ আফ্রিকার ডোনাল্ড-ডি’ভিলিয়ার্স-এর বিরুদ্ধে ১৯৯৩-এর ডিসেম্বরে ৬৯ বলে ৭৩ রানের এক চমকপ্রদ ইনিংস খেলা সত্ত্বেও। ৪২ ম্যাচে ৯৮৭ রান (সর্বোচ্চ ৭৩), গড় ২৪.০৭, স্ট্রাইক-রেট ৬০.৪০, ন’টি অর্ধশতরান তো তেমনই ইঙ্গিত দেয়। সঙ্গত কারণেই ১৯৯৭-এর মে মাসের পর আর কোন ওডিআই ম্যাচ খেলবার সুযোগ তিনি পাননি।

ফর্ম পড়ে যাওয়ার কারণে ২০০১ সালের আগস্টে তিনি টেস্ট দল থেকেও বাদ পড়ে যান। হয়ত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঝামেলার কারণেই তিনি ২০০১-০২ মরশুমের ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটেও নিউ সাউথ ওয়েলস দলের হয়েও তেমন সুবিধে করতে পারেননি। পরবর্তী বছর দুয়েক কিছুটা চেষ্টা করলেও ফর্মে ফিরতে আর পারেননি। ২০০৩-০৪ মরশুমে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০০৪-এর জুন মাসে অবসর নেন। তবে ইতিমধ্যেই ধারাভাষ্যকার হিসেবে বেশ নাম করে ফেলায় তিনি সেদিকেই মনোনিবেশ করেন। সে পর্ব আপাতত থাক। 

ছবি ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

তবে খেলোয়াড়-জীবনে (এবং ধারাভাষ্যকার-জীবনেও) ব্যক্তিগত ও পেশাগত ব্যাপারে মাঠের বাইরে মাঝেমধ্যেই নানারকম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস তাঁর অনেক দিনের – বিবাহবিচ্ছেদের চাপ, মাদকসেবনের অভিযোগ, মহিলাঘটিত সমস্যা, নাইটক্লাব সংস্কৃতির প্রতি অত্যাসক্তি – এর ফলে তাঁর বাহ্যিক ভাবমূর্তির অনেক ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে তাঁর পেশাগত জীবনেরও। তাঁর অল্পবয়সে তাঁর মায়ের গৃহত্যাগ, দীর্ঘকালস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতা-উদ্বেগ-বিষণ্ণতা এসবের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই, নিজের বিবাহিত জীবনের সমস্যা ও গার্হস্থ্য হিংসা এইসবে তাঁর জড়িয়ে পড়া থেকে তাঁকে নাকি অনেকটা বাঁচিয়ে রাখত ক্রিকেট মাঠ, এমনই আভাস দিয়েছেন তাঁর অনেকদিনের ওপেনিং-জুড়ি ও পরবর্তীকালের অধিনায়ক মার্ক টেলর – স্ল্যাটারের আত্মজীবনী “Slats: the Michael Slater Story” বইয়ের ভূমিকায়: “Michael, as you will read, can be a complex character. However, on the cricket field he was quite simple. He loved playing and loved attacking, which was an enormous benefit to the sides that I was lucky enough to be in alongside him.

গতকাল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাইকেল স্ল্যাটারের দীর্ঘদিনব্যাপী দুরবস্থা, আইনীভাবে অভিযুক্ত হওয়া এবং মানসিক রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এইসব খবর দেখে তাঁর জীবনের সারাবেলা ধরে চলা এই পাওয়া-না-পাওয়ার খেলা থেকে ঘটে যাওয়া কান্ডগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই লেখাটা লিখে ফেললাম।

আন্তরিক কামনা করি উনি সেরে উঠে সুস্থজীবনে ফিরে আসুন।