কলকাতা টেস্ট জয়ের একুশ বছর

সিরিজের প্রথম টেস্টে ওয়াংখেড়ে-তে ভারতকে ১০ উইকেটে উড়িয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিংয়ে একা কুম্ভসম শচীনের দু’ইনিংসে ৭৬ আর ৬৫ আর বোলিংয়ে ১ম ইনিংসে হরভজনের ৪/১২১ মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্ন-গিলেসপি-র ২ ইনিংস মিলিয়ে ৫টি করে উইকেট নেওয়া এবং ১ম ইনিংসে হেডেন (১১৯) ও গিলক্রিস্ট (১২২) তান্ডবের ১৯৭ রানের জুটির কাছে। ৩ টেস্টের সিরিজে ০-১ পিছিয়ে থেকে কলকাতায় এল ভারত, তখন অমিত শক্তিধর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে, ইডেনে।

বাঁকের মুখে দাঁড়ানো সেই ২০০১-এর ভারত-অস্ট্রেলিয়া কলকাতা টেস্ট শুরু হয়েছিল ১১ই মার্চ ২০০১ তারিখ, রবিবারে। স্লেটার-হেডেন-ল্যাঙ্গার-ওয়াগ ভাইরা মিলে প্রথম চার ঘন্টাতেই ১-০ এগিয়ে থাকা তিন টেস্টের সিরিজ পকেটে পুরে ফেলার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছেন। ইনিংসের ৭১.১ ওভারে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেছে ৪/২৫২-তে। পরের তিন বলেই তাদের ৭/২৫২-এ পিছলে যাওয়া দেখতে হবে, ইডেনে হাজির কেউই বোধহয় ভাবেন নি। ভুল বললাম, একজন কুড়ি বছর পেরনো তরুণ ভেবেছিলেন, তাঁর নাম হরভজন সিং। সেদিন অস্ট্রেলিয়া ইনিংসে ৭২তম ওভারের প্রথম বলের পরের তিনটি বলে তাঁর অর্জন ছিল এইরকম:- ৭১.২ পণ্টিং এলবি ডবলিউ বো হরভজন সিং – ৬। ৭১.৩ গিলক্রিস্ট এলবি ডবলিউ বো হরভজন সিং – ০। ৭১.৪ ওয়ার্ন ক রমেশ বো হরভজন সিং – ০। ঐ হ্যাটট্রিকই সেদিন ছিল ঐ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দিকে ভারতের প্রথম আঘাত এবং কোন ভারতীয় বোলারের অর্জিত প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক। প্রথম দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেছিল ৮/২৯১-এ, স্টিভ অপরাজিত ছিলেন ২৯-এ।

লিখে রাখা চিত্রনাট্য ধরেই এগিয়ে ক্রিকেটবিধাতা তার পরের দিন ১২ মার্চ ২০০১ তারিখে স্টিভ-গিলেসপির ১৩৩ রানের ৯ম উইকেট জুটি এবং স্টিভ-ম্যাকগ্রার ৪৩ রানের ১০ম উইকেট জুটির জোরে অস্ট্রেলিয়াকে পৌঁছে দেবেন ৪৪৫য়ে, স্টিভ করবেন দায়িত্বশীল ১১X৪ ও ১X৬য়ে সাজানো ১১০। ঐ ইনিংসের শেষে হরভজনের বোলিং বিশ্লেষণ হবে ৩৭.৫-৭-১২৩-৭। তাঁর সাত শিকার ছিলেন হেডেন-মার্ক-স্টিভ-পণ্টিং-গিলক্রিস্ট-ওয়ার্ন-গিলেসপি। জবাবে টপ অর্ডারের নিম্নমধ্যবিত্ত রানের মিছিলে কোণঠাসা হয়ে যাবে ভারত, ২য় দিনের শেষে পৌঁছে যাবে ৮/১২৮-এ, লক্ষ্মণে বিদ্রোহী অপরাজিত ২৬-এও অর্ধনমিত থাকবে প্রতিরোধের পতাকা।

অতঃপর ৩য় দিন ১৩ মার্চ ২০০১-এ খেলায় লক্ষ্মণ মরিয়া প্রতিরোধে ১২টি চারের সাহায্যে করলেন ৫৯ রান, টেল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লো আর ১৭১ রানে গুটিয়ে গেল ভারতীয় ১ম ইনিংস। ২৭৪ রানের প্রথম ইনিংস লিড নিল অস্ট্রেলিয়া, ম্যাকগ্রার ঘাতক ৪/১৮ আর গিলেসপি-কাসপ্রোভিচ-ওয়ার্নের ২টি করে উইকেটের বদান্যতায়। তারা ফলো অন করায় ভারতকে আর ফলো অন করে যথেষ্ট ভালো শুরু সত্ত্বেও ২য় ইনিংসে ০/৫২ থেকে ৩/১১৫ ছুঁয়ে ৪/২৩২ হয়ে গেল ভারত, অবস্থার উপযোগী ইনিংস খেলতে পারলেন না প্রথম সারির চার ব্যাটার, রমেশ (৩০), শিবসুন্দর (৩৯), শচীন (১০), সৌরভ (৪৮)। লক্ষ্মণ অবশ্য মারমুখী শতরান (অপরাজিত ১০৯) করে ফেলেছেন দিনশেষের আগে, সদ্য নামা অপরাজিত ৭ রানে দাঁড়িয়ে থাকা রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে। ৪/২৫৪-এ ৩য় দিন শেষ করলো ভারত।

পরদিন ১৪ মার্চ ২০০১ ছিল ম্যাচের ৪র্থ দিন। আধিদৈবিক সব ঘটনা ঘটলো সেদিন। ম্যাকগ্রা-গিলেসপি-কাসপ্রোভিচ-ওয়ার্নের বিরুদ্ধে ৯০ ওভারেও অবিচ্ছিন্ন থেকে লক্ষ্মণ-রাহুল ৩৩৫ রান যোগ করলেন একদিনে, একটিও উইকেট পতন হতে না দিয়ে। এই ৩৩৫-এর মধ্যে লক্ষ্মণ করলেন ১৬৬, রাহুল করলেন ১৪৮, বাকিটা অতিরিক্ত। ৪/৫৮৯-এ দিন শেষ করলো ভারত, লক্ষ্মণ অপরাজিত ২৭৫ আর রাহুল অপরাজিত ১৫৫। ম্যাচের চালকের আসন থেকে অস্ট্রেলিয়াকে নামিয়ে দিয়ে ভারত বসে পড়ল সেখানে। তার আগে টানা ১৬টি টেস্ট জিতে আসা অস্ট্রেলিয়াকে সেদিন বিপন্ন লাগছিল অনেকদিন পরে।

তারপরে এই টেস্টের শেষ দিন চলে এল আজ থেকে ঠিক ২১ বছর আগে। তারিখটা ছিল ১৫ মার্চ ২০০১। সেদিন ক্রিকেটবিধাতাকে নতুন করে লিখতে হলো এই টেস্ট উল্টোরথের চিত্রনাট্য। তাতে লেখা ছিল, ফলোঅন করে ২য় ইনিংসে মোট ৩৭৬ রানের ৫ম উইকেট জুটি হবে লক্ষ্মণ-রাহুল মিলে। ৪/২৩২ থেকে শুরু করে লক্ষ্মণ-রাহুল জুটি যখন লক্ষ্মণ আউট হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হবেন, তখন ফলো অন করতে বাধ্য হয়ে ভারতের ২য় ইনিংস পৌঁছে যাবে ৬০৮ রানে। ৬৩১ মিনিটে ৪৫২ বলে ২৮১ করে লক্ষ্মণ আউট হবেন, ম্যাকগ্রার বলে পন্টিংয়ের হাতে ধরা পড়ে। ৪৪টা ৪ দিয়েই ১৭৬ করবেন লক্ষ্মণ ঐ ইনিংসে, ২৮১-র মধ্যে, ম্যাচে করবেন ৩৪০ রান। আর ঐ ইনিংসেই ২০-টা চারের সাহায্যে ৪৪৬ মিনিটে ৩৫৩ বলে ১৮০ করে রান আউট হবেন রাহুল, ভারত তখন পৌঁছে যাবে ৭/৬২৯ রানে। ম্যাচে ২০৫ রান করবেন রাহুল। শেষ পর্যন্ত ৭/৬৫৭ রানে ২য় ইনিংস ঘোষণা করবে ভারত শেষদিনের প্রথম সেশনেই, অস্ট্রেলিয়াকে ৩৮৪ রানের জেতার টার্গেট দিয়ে। বিপক্ষের ৬৫৭ রানের ইনিংসেও ম্যাকগ্রার বোলিং হিসেব ছিল ৩/১০৩।

এবং ২১২ রানে গুটিয়ে গিয়ে ১৭১ রানে হেরে যাবে তখন বিশ্বত্রাস স্টিভের অস্ট্রেলিয়া, শেষতম সেশনে ৭টি উইকেটকে শিশিরবিন্দুর মত ঝরে পড়তে দিয়ে। ওপেনার দুজন হবেন দলের সর্বোচ্চ রানকারী প্রথম দুই ব্যাটার। দলের ৭৪ রানের মাথায় স্লেটারকে (৪৩) হারাবে অস্ট্রেলিয়া। চা-য়ের আগে পড়ে যাবে আরো দুই উইকেট (ল্যাঙ্গার ২৮ আর মার্ক ০), দলের ১০৬ আর ১১৬ রানের মাথায়। চা-য়ের পরে কিছুক্ষণ লড়াই জারি রাখবেন হেডেন-স্টিভ। স্টিভ (২৬) ফিরে যাবেন দলের ১৬৬ রানের মাথায়। তারপরে ৫ ওভারের মধ্যে ৪/১৬৬ থেকে ৮/১৭৪ হয়ে যাবে অস্ট্রেলিয়া, সাজঘরে ফিরে যাবেন পন্টিং (০), গিলক্রিস্ট (০), হেডেন (৬৭) আর ওয়ার্ন (০), এরই ফাঁকে “পেয়ার” করবেন গিলক্রিস্ট ও ওয়ার্ন। গিলেসপি (৬) আউট হবেন দলীয় স্কোর ৯/১৯১-তে পৌঁছে দিয়ে। শেষ উইকেটে কাসপ্রোভিচ (অপরাজিত ১৩) আর ম্যাকগ্রার (১২) মরণপণ লড়াই শেষ হবে ২১ রানের জুটি টিমের রান ২১২তে পৌঁছে দেবার পরে। এবং আবার ৬টি উইকেট লেখা থাকবে হরভজনের নামের পাশে, যাঁর বোলিং গড় হবে ৩০.৩-৮-৭৩-৬। এবারের শিকার স্লেটার-ল্যাঙ্গার-স্টিভ-পণ্টিং-গিলেসপি-ম্যাকগ্রা। শেষ দিন মাঠে থেকে দেখেছিলাম অধিনায়কের প্রশ্রয় পেলে কতটা আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে তাঁর স্পিন বোলিং। ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ছিল ১৩ উইকেট, ১৯৬ রান দিয়ে। যদিও ম্যাচে ৩৪০ রানকারী লক্ষ্মণ ম্যাচসেরা হয়ে যান, ম্যাচে ১৩ উইকেট নেওয়া তাঁকে পিছনে ফেলে। শচীন ব্যাটে ব্যর্থতা পুষিয়ে দেবেন ২য় ইনিংসে বল করে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গিলক্রিস্ট-হেডেন-ওয়ার্নকে আউট করে দিয়ে, মার্কের উইকেট নেবেন রাজু। এই ম্যাচে দলগত  লড়াইয়ের মধ্যেও উজ্জ্বল দেখাবে হরভজন সিংকে। আর সিরিজ ১-১ করে ফেলেছিল সৌরভের “টিম ইন্ডিয়া”। শেষ টেস্টে চেন্নাইতে কঠিন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে ২-১ ফলে সিরিজ জেতার বীজ পোঁতা হয়েছিল এই ইডেন টেস্টেই।

শেষ দিন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম ইডেনে এই জয়ের, যা থামিয়ে দিয়েছিল স্টিভের অস্ট্রেলিয়ার টানা ১৬ ম্যাচ ধরে ছোটা অশ্বমেধের ঘোড়া। “বিলক্ষ্মণ” মনে আছে, মনে থাকবে ঐ টেস্টে লক্ষ্মণের ইনিংসটা। আর রা না কেড়ে হুল ফোটানো দ্রাবিড়ের ইনিংসটাও। মূলত যার উপর ভর করে (হরভজনের বোলিংও ভুলিনি, প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিক ছিল) সৌরভের নেতৃত্বে ভারতের টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয়টা দেখেছিলাম সেদিন চোখের সামনে, অমিত শক্তিধর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। দেখেছিলাম, ম্যাচশেষে ইডেনের প্রায় নব্বই হাজার দর্শককে আনন্দে পাগল হয়ে যেতে। ম্যাচশেষের প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হওয়া ভিকট্রি ল্যাপ না দেখে একজন দর্শকও মাঠ ছাড়েন নি সেদিন। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীকে সেদিন একতার ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট।

আজ ২১ বছর পরেও এই টেস্টের কথা লিখতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।