স্মৃতির অ্যালবামে আজও টাটকা, কিন্তু ক্যালেন্ডারের খসে-যাওয়া পাতাগুলোর মধ্যে দিয়ে দেখতে দেখতে কেটে গেছে দীর্ঘ ৩৬ টা বছর। তখন পঞ্চদশী একদিনের ক্রিকেটের গাত্রদেশে আইপিএলের ‘চড়াম-চড়াম’ চমকানির বাদ্যি সেভাবে বাজেনি। বোধহয় তাই আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে রূপকথার গল্প হয়েই থেকে গেছে ‘ড্রামা ইন ডেজার্ট’-এর রোমহর্ষক কাহিনি। ১৯৮৬ সালের আজকের (১৮ এপ্রিল) তারিখে স্টেডিয়াম-ঠাসা বিস্ফারিত চোখের সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ান-ডে ক্রিকেটের সম্ভবত সবচেয়ে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটি।
শারজায় সেবার অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ, ভারত আর পাকিস্তান। এটা এমন দুটি দেশের মরণপণ ক্রিকেটীয় যুদ্ধ, যার গুরুত্ব, আয়োজন ও উত্তেজনার কাছে ‘অ্যাসেজ’-এর লড়াইও ধারে ও ভারে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর মনে হতে বাধ্য। সেমি-ফাইনালে পাকিস্তান ১০ উইকেটে নিউজিল্যান্ডকে এবং ভারত ৭ উইকেটে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। ফাইনালে ভারত সন্দীপ পাটিলের জায়গায় টিমে আনে দিলীপ বেঙ্গসরকারকে। সেই উত্তেজক টক্করে টস জিতে পাক-অধিনায়ক ইমরান খানের ‘ফিল্ড’ করার সিদ্ধান্তটি প্রায় কেঁচে গিয়েছিল ভারতের দুই ওপেনার সানি গাভাস্কর (৯২) আর কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত (৮০ বলে ৭৫) প্রথম উইকেটেই ১১৭ রান তুলে ফেলায়। তবে বেঙ্গসরকারের ৫০ সত্ত্বেও আক্রম (৩ উইকেট), ইমরানের (২ উইকেট) বলে মিডল-অর্ডারের ব্যর্থতায় নির্ধারিত ৫০ ওভারে ভারত আটকে যায় ২৪৫/৭-এ।
পাল্টা ব্যাট করতে নেমে গোড়াতেই পাকিস্তান ধাক্কা খায় – ৬১/৩। কিন্তু পরবর্তী টানা-পোড়েনে আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি আমরা পৌঁছে যাবো একেবারে শেষ অর্থাৎ ৪৯-তম ওভারে। পাকিস্তান তখন ২৩৫/৭। ম্যাচের ওপর ৮০ শতাংশ দখল নিয়ে সেঞ্চুরি করে ক্রিজে নট নড়ন-চড়ন জাভেদ মিয়াঁদাদ।শেষ ওভারে তখন দরকার ১১ রান। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ‘ইনফিল্ড’ আলোচনার পরে শত্রুবধের দায়িত্ব চেতন শর্মার হাতে তুলে দিলেন ক্যাপ্টেন কপিলদেব। রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল ঘিরে তখন গোটা স্টেডিয়াম চিৎকার জুড়েছে তুমুলভাবে পাকিস্তানের পক্ষে।
শেষ ওভারের প্রথম বল চেতন শর্মার। মিয়াঁদাদ তুললেন লং-অনে। কিছুটা দৌড়ে বাউন্ডারি বাঁচিয়ে কপিলের সোজা নিখুঁত থ্রোয়ে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান-আউট ওয়াসিম আক্রম (৩)। ৫ বলে চাই ১০ রান। দ্বিতীয় বল চেতন শর্মার। মিয়াঁদাদের ব্যাটের চাবুকে মিড-উইকেট দিয়ে বল চলে গেল বাউন্ডারির বাইরে। ৪ বলে দরকার ৬ রান। তৃতীয় বল – একটা সিঙ্গলস নিয়ে ফেললেন মিয়াঁদাদ। চতুর্থবল – গোটা মাঠ যেন ককিয়ে উঠল, জুলকারনাইন (০) বোল্ড! শেষ উইকেটে ব্যাট করতে এলেন তৌসিফ আহমেদ তাঁর সামনে তখনও অপেক্ষায় দুটি ঘাতক বল। মিয়াঁদাদের সিঙ্গলস নেওয়াটা ‘নির্বোধতম’ সিদ্ধান্ত হল কিনা সেই সমালোচনায় যখন মনে মনে হিসাব কষায় ব্যস্ত অনেকেই, ঠিক তখনই পঞ্চম বলে পিঠ আর মান বাঁচাতে কোনও মতে ব্যাটে বল ঠেকিয়েই পড়িমড়ি ছুটলেন তৌসিফ। এবং বল পিক-আপে আজহারউদ্দিনের সামান্য গাফিলতিতে নিশ্চিত রান আউটের হাত থেকে বাঁচলেন। শেষ উইকেট, শেষ বল, চাই ৪ রান। টগবগে ম্যাচ তখন উত্তেজনার চরমে। একদিকে চেতন শর্মা, অন্যদিকে জাভেদ মিয়াঁদাদ ভাবছেন — কী হবে ভাগ্য-লিখন? নির্মম নিন্দা, নাকি প্রচুর প্রশংসা? চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে ‘স্টান্স’ নিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। শুধু স্টেডিয়াম নয়, টিভির পর্দায় হুমড়ি খাওয়া আট থেকে আশির বুকের ধড়াস-ধড়াস শব্দ পাশের লোকের কানেও যেন চলে যাচ্ছে। লাস্ট বল। এই পরিস্থিতিতে একটা নিখুঁত ইয়র্কারই ভারতকে এনে দিতে পারে কাঙ্খিত জয়। ডেলিভারিটি করলেন চেতন। ‘রিলিজ’-এর সামান্য ভুলে বলটা ‘ফুলটস’ হয়ে গেল। শরীরের সব শক্তি এক করে মরিয়া মিয়াঁদাদ মহোল্লাসে মারলেন এক মস্ত শট। স্বর্গীয় গন্তব্যের দিকে উড়ে-যাওয়া সেই মহা-মূল্যবান ছক্কাটি এনে দিল বড় টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের ‘প্রথম’ জয়, মরু-শহরের ক্রিকেট ‘কোহিনূর’।
হেডিং তৈরি হয়ে গেল –“Last ball ‘SIX’ dashes India’s dreams.”