লজ্জা থেকেই শিক্ষা নিক নাইট ম্যানেজমেন্ট

তিন বছর পর আইপিএলের সেই পুরনো ছবি ফিরেছে। একটা টিকিট জোগাড় করবার শেষ মুহূর্তের আপ্রাণ চেষ্টা, ব্ল্যাকারদের অনুচ্চে পিছুডাক, সিএবি-তে ক্লাবকর্তাদের ভিড়, নানান লোকের আনাগোনা, পুলিশি তৎপরতা। আইপিএল জ্বরে আক্রান্ত কলকাতা। শহরটা আবার বহুদিন পর ক্রিকেটীয় সাজে সেজে উঠেছে। ৭০০০২১-এর ফ্লাডলাইটগুলোও দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জ্বলে ওঠার যথার্থ কারণ খুঁজে পেয়েছে।


বাবুঘাটে বিসর্জন থাকলেও বছরের অনেক দিন এভাবে আকাশটাকে আলোয় ঢেকে রাখে ফ্লাডলাইটগুলো। এও তো এক বিসর্জনই। আইপিএলের পঞ্চদশ সংস্করণের শুরুর দিকে যে দলটা শীর্ষে ছিল, লিগ যত গড়িয়েছে, ধারাবাহিক ব্যর্থতায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে তারাই অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই করেছে। ‘সব’ শেষে ‘শব’-টুকুই পড়ে রয়েছে। প্লে-অফের দু’টি ম্যাচ ঘিরে ইডেন গার্ডেন্স যখন সেজে উঠেছে নানান রঙে, নাইট রাইডার্স এবারের আইপিএল থেকে তখন বিলীন।
গতবার কোভিডের জন্য আইপিএল মাঝপথে বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেকেআর এক সাদামাটা দলই ছিল। বেঙ্কটেশ আয়ারের অকল্পনীয় ব্যাটিং সব হিসেব পালটে দিয়েছিল। ফাইনালে হারলেও বেঙ্কটেশ আয়ার তাঁর ধারাবাহিকতার বিরাট পুরস্কার পেয়েছিলেন। আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনের মতো বিদেশির পাশাপাশি তাঁকেও নিলামের আগে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নাইট ম্যানেজমেন্ট। গত মরশুমের আরেক নায়ক বরুণ চক্রবর্তীকেও ধরে রাখে কেকেআর। এই আইপিএলে নাইটদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সম্ভবত এই দুই ক্রিকেটার। আয়ার তবু কয়েকটা ম্যাচে জ্বলে ওঠার ঝলকানি দেখান।
বেঙ্কটেশ এবং বরুণ― এঁদের ব্যর্থতার দুটো দিক থাকতে পারে। শুভমান গিল, রাহুল ত্রিপাঠীদের মতো ক্রিকেটারকে যেতে দিয়ে এই দুইয়ের ওপর ভরসা দেখানো হয়েছিল। গত বছর বরুণের আকাশছোঁয়া সাফল্য তাঁকে তড়িঘড়ি টি২০ বিশ্বকাপের দলে পর্যন্তও জায়গা করে দিয়েছিল। ক্রিকেট যেমন মাঠের খেলা, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক কাঠিন্যের খেলা। বেঙ্কটেশদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ধরে রেখে যে বিপুল আস্থা দেখিয়েছিল, তার দাম চোকাতে গিয়ে তাঁরা প্রতি মুহূর্তে চাপ অনুভব করেছেন। তাঁদের ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি দিকও থাকতে পারে। বাস্তবে তেমনটা হয়ে থাকলে ভয়ঙ্কর তার পরিণাম। গত মরশুমে বেঙ্কটেশ আয়ার এবং বরুণ চক্রবর্তী নিয়ে বিপক্ষের তেমন পড়াশোনা ছিল না। সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন হয়েই প্রতিপক্ষ দলের পরীক্ষার্থীদের বারবার খোঁচা মেরেছিলেন। এবার তাঁদের ভিডিও বিশ্লেষণ করে রহস্যভেদ করে ফেলেছিল বাকিরা। এমন দুই ক্রিকেটারের ওপর নাইট ম্যানেজমেন্ট বাজি ধরল, যাঁদের অধিকাংশ ম্যাচে বেঞ্চেই বসতে হল।


কেকেআর বাংলা বিদ্বেষী – এত বড় একটা অভিযোগ দুম করে করে দেওয়া যায় না। অতীতে এ রাজ্যের বহু ক্রিকেটার খেলেছেন। বিনিয়োগকারীর কাছে আবেগের মূল্য থাকে না। অনেক বেশি বাস্তববাদী হতে হয়। ওয়েন রুনি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডকে এত কিছু দেওয়ার পরেও কেরিয়ার সায়াহ্নে তাঁর সঙ্গেও গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সেরে ফেলে ক্লাব। পেশাদার দুনিয়ায় আবেগের কোনও দাম নেই। শুধু একটাই ছোট প্রশ্ন ম্যানেজমেন্টের কাছে। শেল্ডন জ্যাকসন, বাবা ইন্দ্রজিৎ-এর চেয়ে কি ঋদ্ধিমান সাহা বেশি ভরসাযোগ্য হতে পারতেন না? একজন ভালো ওপেনারের অভাব শুরু থেকেই টের পাচ্ছিল দু’বারের চ্যাম্পিয়নরা। তবু ঋদ্ধিমান সাহা নন।

ঋদ্ধি যখন নিলামে প্রথমবারে অবিক্রীত থেকে যাচ্ছেন, টিভির পর্দায় বেঙ্কি মাইসোরকে দেখা যায় ভাবলেশহীনভাবে অন্য প্রসঙ্গে হাসাহাসি করছেন। অর্থাৎ, ঋদ্ধি যে তাঁদের পরিকল্পনায় কখনওই ছিলেন না, তা স্পষ্ট ছিল। বাংলার আরেক তারকা শাহবাজ আহমেদ নিজের মাঠে প্লে-অফ খেলবেন। তাঁকে নিলাম থেকে ফের কিনে দলের অন্যতম সম্পদে পরিণত করেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। ঋদ্ধিরা যখন একার কাঁধে দলকে জেতান, কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্ট একটা অদৃশ্য চড় নিজেদের গালে অনুভব করে।
এবারের আইপিএলে কলকাতা বোধহয় রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। প্রায় পাঁচ-ছ’টি ওপেনিং জুটিকে দেখে নিয়েছেন ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। শুধু ওপেনিং জুটিই নয়, একাদশেও বারবার ছুরি-কাঁচি চলেছে। তা সত্ত্বেও একটা কম্বিনেশন শেষ ম্যাচ অবধি হাতড়ে বেরিয়েছে কেকেআর। শ্রেয়স আয়ারও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, অভিষেক নায়ার ও শ্রেয়সকে নিয়ে যে কোর লিডারশিপ গ্রুপ ছিল নাইটদের, সেখানে অধিনায়ককে কার্যত ক্ষমতাহীন করে রাখা নাইটদের ব্যর্থতার সব চেয়ে বড় কারণ। যাবতীয় ক্ষোভ প্রশমন করে খেলতে হয়েছে, একটি শব্দও করতে পারেননি শ্রেয়স। নিলামে ৭.২৫ কোটি টাকা দিয়ে প্যাট কামিন্সকে কিনে তাঁকে বসিয়ে রাখার পরেও শ্রেয়সের মতামত দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমন এক ফ্র্যাঞ্চাইজির যে পরিণতি হওয়ার কথা, তা-ই ঘটেছে। এর মধ্যেও প্রাপ্তি বলতে, উমেশ যাদবের নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার, আন্দ্রে রাসেল এবং সুনীল নারাইনের মর্যাদার দাম রাখা এবং পরিশেষে এক বিদ্রুপের পাত্র থেকে ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে থাকা রিঙ্কু সিং।