মেলবোর্নে শতবার্ষিকী টেস্টের শেষে ড্রেসিংরুমে পঁচাত্তর হাজার ডলার!

অস্টিন রবার্টসন নামে একজন অস্ট্রেলিয়ানকে কতজন ক্রিকেট-প্রেমী মনে করতে পারেন? আচ্ছা, একটু খেই ধরিয়ে দিই – আজ থেকে ৪৫ বছরেরও আগেকার কথা তো – ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক!

  • স্থান: মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠের অস্ট্রেলিয়ান-দলের ড্রেসিংরুম।
  • কাল: ১৯৭৭ সালের ১৭ই মার্চ বিকেল / সন্ধে – সবে শেষ হয়েছে শতবার্ষিকী ক্রিকেট-টেস্ট।
  • পাত্র: অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট-দলের খেলোয়াড়রা, এবং বব প্যারিশ, রে স্টিল ও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের (ACB) আরো কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
  • দৃশ্য: একটা ঐতিহাসিক উত্তেজনাময় টেস্ট-ম্যাচ (ক্রিকেট-ইতিহাসের ৮০০তম) ৪৫ রানে জেতবার পর বিজয়ানন্দে মাতোয়ারা, পরস্পরকে অভিনন্দনরত, বিয়ারের গ্লাস-মগ হাতে উদযাপনকারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপরত ACB-র কর্মকর্তারা।

এমতাবস্থায় সেখানে ঢুকলেন এক ব্যক্তি, তাঁর হাতের ব্রিফ-কেসটা থেকে বার করলেন কতকগুলো চেক – সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার ডলারের – হাঁ-করে তাকিয়ে থাকা প্যারিশ ও স্টিল-এর সামনেই তিনি সেগুলো খেলোয়াড়দের মধ্যে বিতরণ করতে থাকলেন, “বন্ধুরা, এই যে আপনাদের নাটকের টিকিট!”, এই বলতে বলতে। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, “That’s how we did it, and though it seems unbelievable, no one suspected a thing.

এই ব্যক্তিটিই ছিলেন অস্টিন ‘ওকার’ রবার্টসন, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের রাজধানী পার্থ শহরের সুবিয়াকো (অস্ট্রেলিয়ান রুলস) ফুটবল ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়, ডেনিস লিলি-র তৎকালীন ম্যানেজারও বটে। তা নাহয় হ’ল, কিন্তু এর মধ্যে তিনি আবার কেন? কারণ, ১৯৭৪ সালে নিজের ফুটবল-জীবন থেকে অবসর নিয়ে তিনি কেরি প্যাকারের সংস্থায় যোগ দেন এবং ১৯৭৭ সালে ওয়ার্লড সিরিজ ক্রিকেট (WSC) স্থাপন করতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন।

কেরি প্যাকার! নামটা চেনা-চেনা লাগছে তো? লাগবেই – রঙিন পোশাকে, সাদা বলে, দিন-রাতের একদিনের ক্রিকেটের মুখ্য সৃষ্টিকর্তা, যিনি আজ থেকে সাড়ে-চার দশক আগে ক্রিকেটের প্রচলিত দুনিয়াটাকে পুরো ওলট-পালট করে দেন। আজকের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট প্রতিযোগিতার জন্মদাতা বললেও ভুল হবেনা। আর বিগত চার দশকের দুনিয়ার সমস্ত ‘পেশাদার’ ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর পথিকৃৎ। 

লেখকের ব্যক্তিগত পুস্তক-সংগ্রহ থেকে

“ইয়ে ক্যা হুয়া, ক্যায়সে হুয়া, কব্ হুয়া, কিঁউ হুয়া” – (সংক্ষেপে) জানতে গেলে তাকাতে হবে ১৯৭৭ সালের শতবার্ষিকী টেস্টের অভাবনীয় সর্বাত্মক সাফল্যের পর ACB-র পরিচালনাধীন পরবর্তী ম্যাচগুলোর টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব নিয়ে জোরদার এক দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে – এক তরফে এতদিনের প্রতিষ্ঠিত সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (ABC), অন্য তরফে কেরি প্যাকারের তরুণ তুর্কি সংস্থা চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্ক (Channel-9) – এই লড়াইয়ে বহু চেষ্টাতেও Channel-9 হেরে যায়। 

তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন অপেশাদার, এবং ACB তাঁদের মোটেই ভাল পারিশ্রমিক দিতনা, এমনকি ডেনিস লিলি, গ্রেগ চ্যাপেল, রড মার্শ, জেফ টমসন এঁদের মতন দর্শক-আকর্ষণকারী তারকারাও তাঁদের যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার অনুপাতে খুবই কম অর্থ পেতেন। প্যাকারের ভাষায়: “(Cricket) was the easiest sport in the world to take over … nobody bothered to pay the players what they were worth.” অতএব অতি দ্রুত তিনি আরম্ভ করেন অনেক বেশি অর্থের চুক্তি করে ক্রিকেটারদের তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত WSC-র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবার জন্য – ACB-পরিচালিত প্রতিযোগিতাগুলোর বদলে – যে ম্যাচগুলো তাঁর Channel-9-এর মাধ্যমে সম্প্রচারিত হবে।

অতএব WSC-র প্রতিনিধিরা গোটা দুনিয়ার প্রধান আকর্ষক ক্রিকেটীয় শক্তি – অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান – এইসব দেশের প্রধান প্রধান ক্রিকেটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন. প্রস্তাব গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে (১৯৭০ সাল যাবৎ) বঞ্চিত দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারদের কাছেও। অভূতপূর্ব সাড়া পেলেন প্যাকার আর শুরু হয়ে গেল WSC-র যাত্রা। সেই ‘লম্বি কহানি’ এখানে বর্ণনা করছিনা, চাইলে Christopher Lee-র “Howzat!” বা Gideon Haigh-এর “The Cricket War” পড়ুন।  

ছবি :ইন্টারনেট

অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এই চার দেশের ক্রিকেট বোর্ড এইসব ‘Packer Pirate’ ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করে, এবং বাধ্য হয় পরবর্তী দটো মরশুম, ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৭৮-৭৯, দ্বিতীয় (এমনকি তৃতীয়) সারির টেস্ট বা একদিনের দল খেলাতে – কারণটা সঙ্গের খেলোয়াড় তালিকাটা দেখলেই বুঝবেন [যদিও ১৯৭৮ সালে ভারতের পাকিস্তান সফরকালে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ছাড় দেওয়া হয়েছিল সেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজের গুরুত্ব বিবেচনা করে।] ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ইংল্যান্ডে এই নিয়ে বড়সড় মামলাও হয়। সে আরেক গল্প! 

ছবি লেখকের ব্যক্তিগত পুস্তিকা সংগ্রহ থেকে

ক্রিকেট-দুনিয়ায় WSC-র বিশাল প্রভাব পড়ে। তার যৎসামান্য আভাস দিই: “The day the world’s top cricketers turned pirate” – that was the headline of Daily Mail on 09-May-1977 when the Australian TV magnate Kerry Packer’s plans for World Series Cricket were leaked. John Arlott called it “a circus”; EW Swanton ended his friendship with the England captain Tony Greig; সঙ্গের সংবাদপত্রের খবরগুলোও দেখুন।

ছবি ইন্টারনেট

সৌভাগ্যের ঘটনা এই যে ১৭-১৮ মাসের মধ্যেই প্যাকারের মূল দাবিটা – অস্ট্রেলিয়াতে খেলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের টেলিভিশন সম্প্রচারের স্বত্ব – ACB মেনে নেয়, এবং WSC-র জমানাও শেষ হয়, ১৯৭৯-৮০ মরশুম থেকে অবস্থা স্বাভাবিক হয়। তবে তার রেশ থেকে গেছে আজও – রঙিন পোশাক, সাদা বল, দিন-রাতের সীমিত-ওভারের ক্রিকেট চলছে এই সাড়ে-চার দশক পরেও। আর ২০০৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারিখে ‘Pirate’ কেরি প্যাকার মারা যাওয়ার পর ‘বক্সিং ডে’ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের খেলোয়াড়রা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ইতিহাসের ধারা বোধহয় এমনই!