হঠাৎ করেই ঘাড়ে চাপল দায়িত্বটা ।বার্বেডোজে ট্যুর ম্যাচে আচমকাই চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে কানের পাশে মারাত্মক চোট পেলেন ভারত-অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর। ষাটের দশকের শুরুতে হেলমেটের রেওয়াজ ছিল না। ফলে ওই মারাত্মক আঘাতে প্রাণ সংশয় হয়ে পড়ে রক্তাক্ত নরি কন্ট্রাক্ট্ররের। শুধু তৃতীয় টেস্টই নয়, ক্রিকেটে আর কোনওদিন ফিরতেই পারলেন না কন্ট্রাক্টর। ১৯৬২ সালের ২৩ মার্চ ভারতীয় দল ব্রিজটাউন টেস্টে মাঠে নামল প্রথম দুটি টেস্টে দলে জায়গা না-পাওয়া এক ‘তরুণতম’ ক্যাপ্টেনের হাত ধরে। মাত্র ২১ বছর ৭৭ দিন বয়সে বিশাল দেশ ভারতবর্ষের দায়িত্ব চাপল যে মানুষটির কাঁধে, তাঁর নাম মনসুর আলি খান পতৌদি। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে অবশ্য এই বিস্ময়বহ সংবাদটি ততদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের পরিমন্ডলে ছড়িয়ে গিয়েছিল, এই ক্রিকেটারটি ইতিমধ্যেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধিনায়কত্ব করেছেন। এবং ইয়র্কশায়ারের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর যে ঘটনাটা ভারতবাসীকে একইসঙ্গে চমৎকৃত করেছিল, সেটা হচ্ছে, মনসুর আলি ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের হোভে এক মোটর দুর্ঘটনায় ডান চোখে এতটাই সাংঘাতিক আঘাত পান যে, সেই চোখের দৃষ্টি প্রায় হারিয়ে ফেলেন। সেই হেলমেটহীন যুগে, গোটা মাথা এবং শরীরটাই যেখানে বিধ্বংসী পেসারদের সামনে বে-আব্রু, সেখানে মাত্র এক চোখের ভরসায় ক্রিকেটের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও মনোযোগ দাবি-করা খেলায় ব্যাট হাতে মাঠে নামা শুধু কঠিন নয়, ছিল বিপদসংকুলও। দুটি চোখে দুটি বল দেখতেন মনসুর, যার মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত ঘন, অন্যটি হালকা রঙের। এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে মাথার কাউন্টি ক্যাপের ‘হুড’টিকে কিছুটা নামিয়ে, হালকা রঙের বলটিকে ঢেকে, স্টান্স বদল করে ওপেন চেস্টে দাঁড়ানো, একইসঙ্গে অফ সাইডের স্ট্রোকে ফুট-ওয়ার্ক অ্যাডজাস্ট করার মতো অবিশ্বাস্য ক্রিকেটীয় পাঠক্রমের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারগুলি ছিল, এককথায় অলৌকিক। নিজস্ব ব্যাটিংয়ের বাইরে এবার চাপল দলের দায়িত্ব। আর সেটাও মাত্র ২১ বছর বয়সে (২০০৪ সালের মে মাসে জিম্বাবোয়ের তাতেন্দা তাইবু-র আগে পর্যন্ত যা ছিল বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট-অধিনায়কের নজির)।
বাবা টেস্ট ক্রিকেটার ইফতিকার আলি খান ১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে ছেলে মনসুরের জন্য ‘গান অ্যান্ড মুর’ কোম্পানিতে অর্ডার দিয়ে ছোট সাইজের ব্যাট কিনে আনেন। ফ্র্যাঙ্ক উলি এবং জর্জ কক্সয়ের কাছে ক্রিকেট শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ পান, যা ফিল্ডারদের মাথা টপকে বল ‘লিফট’ করার সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছে সারা জীবন। কিন্তু ইংল্যান্ডের মাইক ব্রিয়ারলি কিংবা রে ইলিংওয়ার্থের সঙ্গে তুলনা টেনে অনেকেই পতৌদির ব্যাটিংকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে চান না। তাঁর শারীরিক অক্ষমতার কথা বাদ রেখেও কয়েকটি অনবদ্য ইনিংস ও ক্যাপ্টেনশিপের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৬৪-৬৫ সিরিজে ব্রেবোর্নে ববি সিম্পসনের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দু’ইনিংসে তাঁর ম্যাচ-জেতানো ৮৬ এবং ৫৩ রানের কথা কি ভোলা যায়! ভোলা যায় কি, তার পরে চন্দ্রশেখর আর নাদকার্নিকে লেলিয়ে দিয়ে কেমন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রেখেছিলেন! ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ডবল সেঞ্চুরিটি কি মোছা যাবে? ’৭৪ সালে ক্লাইভ লয়েডের শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইডেনে বোদ্ধাদের চিৎকার উপেক্ষা করে সেই চন্দ্রশেখরকে আক্রমণে রেখে কীভাবে দ্বিতীয় ইনিংসে আউট করে জয় (সিরিজ এক সময় ২-২ ছিল) ছিনিয়ে আনেন।
জীবনে ৪৬ টি টেস্ট খেলেছেন পতৌদি, যার মধ্যে ৪০ টিতে ছিলেন অধিনায়ক। তাঁর হাতে কোনও দাপুটে কপিলদেব ছিলেন না, পাননি সুনীল গাভাসকরের মতো লড়াকু ব্যাটার। ক্রিকেটে আধিপত্য দেখানো দূরের কথা, লড়াইটুকু করতে হলেও যে ফিল্ডিংয়ের মান বাড়াতে এবং দেশীয় পরিবেশে স্পিনকেই ‘অস্ত্র’ হিসাবে ধারালো করতে হবে, এই সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তিনিই। ঠিক ঠিক বললে, নিজে দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলেন বলেই তাঁর আমলে ফিল্ডিংয়ের গুরুত্ব অনেকটাই বাড়ে।অধিনায়ক হিসাবে বিদেশের মাটিতে ‘প্রথম’ টেস্ট ও সিরিজ জয়ের কীর্তি তাঁরই (নিজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬৭-৬৮ মরসুমে)।