অভাবিত বিপর্যয়

ক’দিন আগে বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত ভারত-শ্রীলঙ্কা ‘ডে-নাইট পিঙ্ক বল’ টেস্ট তিন দিনে শেষ হওয়ায় পরে কোনও কোনও মহলে কিঞ্চিৎ বিরূপ মন্তব্য শোনা গিয়েছে। ম্যাচ রেফারি জাভাগল শ্রীনাথের রিপোর্টের ভিত্তিতে বেঙ্গালুরু পিচকে ‘বিলো অ্যাভারেজ’ রেটিং দিয়েছে আইসিসি। বলা হয়েছে প্রথম দিন থেকেই পিচে নাকি বল ‘টার্ন’ নিয়েছে, লাফিয়েছে। সেই সঙ্গে যখন-তখন বল ‘লো’ হয়েছে। পিচের খামখেয়ালিপনার বিষয়টি তর্কের খাতিরে ধরে নিলেও প্রশ্ন থাকে, পিচ যদি ক্রমশ খারাপ হয়ে উঠতেই থাকে তাহলে ভারতীয়রা দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০৩/৯ তুলল কীভাবে? দ্বিতীয় দফায় শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক দিমুথ করুণারত্নেই বা দুর্দান্ত সেঞ্চুরিটি (১০৭) করতে সক্ষম হলেন কী করে? আসলে, শ্রীলঙ্কার এই দলটাই বেশ কমজোরি। তাই ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে মোহালিতেও তারা জাদেজা-অশ্বিন জুটির স্পিন দাপটের সামনে ভেঙে পড়েছিল অসহায়ভাবে। বেঙ্গালুরুতেও তেমনই নুয়ে পড়েছিল বুমরাহ আর অশ্বিনের পেস-স্পিনের সাঁড়াশি চাপে। আসলে, ভেঙে পড়া  বলতে ঠিক কি বোঝায়, সেটার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

১৮৮৯ সালের আজকের তারিখে (২৬ মার্চ, কেপটাউন টেস্টের দ্বিতীয় দিন) মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আগের দিন ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নেমে অল আউট হয়ে যায় ২৯২ রানে। এর মধ্যে ওপেনার ববি অ্যাবেল ধীর-স্থিরভাবে খেলে ৮ নম্বরে আউট হন ১২০ রান করে। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সমারসেটের বিপক্ষে সারে একবার ৮১১ রান তোলে, যার মধ্যে অ্যাবেল একাই ইনিংসের গোড়াপত্তনে এসে ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট’-এর ‘সর্বোচ্চ’ নজির গড়েন অপরাজিত ‘ট্রিপল’ সেঞ্চুরি (৩৫৭) হাঁকিয়ে। ২০১৬-১৭ মরশুমে রঞ্জি ট্রফিতে সমিত গোহেল অবশ্য এতদিন পরে সেই রেকর্ডটি ভাঙেন ৩৫৯ রানে নট আউট থেকে। আশ্চর্য আরেকটি ব্যাপার হল, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাঁ-হাতি স্লো-মিডিয়াম পেসার উইলিয়াম ‘গোবো’ অ্যাশলে একাই ৭ উইকেট নেন ৯৫ রানে। এবং সেটাই ছিল টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাব ম্যাচ! দুঃখের কথা এই যে, জীবনের প্রথম টেস্টে ওই একটিমাত্র ইনিংসে এমন চমকপ্রদ বোলিং করা সত্ত্বেও আর কখনও টেস্ট ক্রিকেটে ডাক পাননি তিনি! যাই হোক, প্রথম দিনের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান ছিল ২ রানে এক উইকেট।

এরপর, দ্বিতীয় দিনে (আজকের তারিখে) যে ‘অবিশ্বাস্য’ কান্ডটি ঘটল কোথায় লাগে ‘বেঙ্গালুরুর বাড়াবাড়ি’। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংসে নুয়ে পড়ল মাত্র ৪৭ রানে! ওপেনার বার্নার্ড ট্যানক্রিড একা আগাগোড়া ইনিংস জুড়ে দলের ভয়ঙ্কর পতন দেখলেন ৯১ বল খেলে ২৬ রানে নট আউট থেকে এবং টেস্ট ক্রিকেটে দেশের ‘প্রথম’ ‘ক্যারিং দ্য ব্যাট’-এর নজির গড়ে। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে এই ধ্বংসলীলার নায়ক ছিলেন ইংল্যান্ডের বাঁ-হাতি স্পিনার জনি ব্রিগস। তখন ওভার ছিল চার বলের। মাত্র ৭৭ বলে ৭ উইকেট পান ব্রিগস ১৭ রান খরচ করে!

কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। ওই দিনেই দ্বিতীয় ইনিংসেও দক্ষিণ আফ্রিকা কার্যত ভূমিশয্যা গ্রহণ করে মাত্র ৪৩ রানে অল আউট হয়ে! এবং এবারেও দেখা গেল বল-হাতে ব্রিগসের বিধ্বংসী রূপ। ৫৮ টি ডেলিভারি করে মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে তোলেন ৮ টি উইকেট! ভাবা যায়, ম্যাচে মাত্র ২৮ রানে ১৫ টি উইকেট! তার চেয়েও বড় কথা, এর মধ্যে ১৪ জন সরাসরি ‘বোল্ড’, একজন ‘লেগবিফোর’! অর্থাৎ অন্য কোনও ফিল্ডারের সহায়তার প্রয়োজন পড়েনি জনি ব্রিগসের! তাঁর সম্পর্কে যেটুকু পড়েছি তাতে ব্রিগসের টার্ন, ফ্লাইট এবং ভ্যারিয়েশন ছিল দারুণ। রান দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর ‘কৃপনতা’ ছিল সর্বজনবিদিত। টেস্ট ক্রিকেটে ‘সর্বপ্রথম’ ১০০ উইকেট নেওয়ার কীর্তিটিও তাঁরই। কিন্তু ভেবে দেখুন, একজন বোলারের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ দলের ১৪ জন সবাই ‘বোল্ড’ বা ‘লেগবিফোর’ হলেন কীভাবে?তাহলে কি ব্যাটারদের প্রত্যাশার চেয়েও বল বেশি নিচু হচ্ছিল? অর্থাৎ পিচের বাউন্স কি ‘অসমান’ ছিল?না, কারও ‘কোয়ালিটি’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ না করেও একটা উত্তর জানতে ইচ্ছে করে — মাত্র দু’দিনেই গোটা টেস্ট ম্যাচটা শেষ হয়ে গেল কেন? তার বেলায় কি শুধুই ‘ব্যাটারদের ব্যর্থতা’ বা ‘বোলারদের বাহাদুরি’ বলে ক্ষান্ত হবো আমরা? ‘ডিমেরিট পয়েন্ট’ পাওয়ার মতো বহু ম্যাচই কিন্তু বহাল তবিয়তে আজও ইতিহাসে রয়ে গিয়েছে।