জো–র ‘‌শিকড়’ অনেক গভীরে

সদ্য সমাপ্ত লর্ডস টেস্টে তিনি তখন ৮৭ রানে অপরাজিত। দাঁড়িয়ে নন–স্ট্রাইকার এন্ডে। বল করতে যাচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের বোলার কাইল জেমিসন। দেখা গেল ব্যতিক্রমী এক দৃশ্য। তিনি দাঁড়িয়ে, পাশে ব্যাটও দাঁড়িয়ে!‌ অদ্ভূত ভারসাম্যে দাঁড় করানো ছিল ব্যাটটা। সেই ব্যাট হাতে নিলেন জো রুট। মুহূর্তে সেই ছবি ভাইরাল হল সোশ্যাল মিডিয়ায়। হ্যাঁ, রুটের সঙ্গে ব্যাটের এখন এতটাই বন্ধুত্ব। প্রথম টেস্টে কিউয়িদের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়ের নায়ককে নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে জোর আলোচনা। নেতৃত্বের শেকল খুলে রুট এখন মুক্ত বিহঙ্গ। 

লর্ডসে জয়ের রান তাড়া করতে নেমে চাপের মুখেও ঝলমলে সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন রুট। দুর্দান্ত সেই ইনিংসে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে পাওয়া গেছে নতুন ভোরের সন্ধান। টেস্টে সাম্প্রতিক সময়ে রীতিমতো কোণঠাসা ছিল ইংল্যান্ড। ‘‌নেতা’‌ রুটের ব্যাটে রানের খরা ছিল না ঠিকই, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে দলকে পৌঁছে দিতে পারছিলেন না তিনি। সমালোচনায় জেরবার হয়ে গেলেন শেষ অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ০–৪ ব্যবধানে পর্যুদস্ত হওয়ার পর। তার আগে তিন টেস্টের সিরিজে দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজও ১–০ জয়ী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। প্রাক্তন ইংরেজ তারকারা কাঠগড়ায় তুলতে শুরু করলেন রুটকেই। এই অবস্থায় অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না তাঁর। 

নতুন নেতা হিসেবে বেন স্টোকস অভিযান শুরু করলেন জয় দিয়েই। আর সেই জয়ে সবথেকে উজ্জ্বল ভূমিকা নিলেন তাঁরই অন্যতম প্রিয় বন্ধু রুট। ২০২১–এর ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ টেস্টে মাত্র একটি জয় পেয়েছিল রুট–ব্রিগেড। ২০২২–এ তাঁর নেতৃত্বে ইংল্যান্ড জয়হীন। ২০১৭–তে অ্যালিস্টার কুকের হাত থেকে নেতৃত্বের ব্যাটন পেয়েছিলেন রুট। ৬৪ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে রুটের পরিসংখ্যান কী বলছে?‌ ২৭ জয়, ২৬ হার, ১১ ড্র। রুটের অধিনায়কত্বে ১৯টি দ্বিপাক্ষিক সিরিজের মধ্যে ইংল্যান্ড জিতেছিল ৮টি, হেরেছে ৯টি। যদিও সাম্প্রতিক ব্যর্থতায় আড়ালে চলে গিয়েছে নেতা হিসেবে রুটের সাফল্যগুলো। দায়িত্ব পেয়ে প্রথম অ্যাওয়ে সিরিজে ২০১৮–য় শ্রীলঙ্কাকে ৩–০ হারিয়েছিলেন। দেশের বাইরে তিন বা তার বেশি ম্যাচের সিরিজে বিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্ব আগে ছিল ইংল্যান্ড অধিনায়ক টেড ডেক্সটারের (‌বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ১৯৬২–৬৩)‌। তারপর রুটই এই কৃতিত্ব স্পর্শ করেছিলেন। সেই বছরই ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ভারত। পাঁচ টেস্টের সিরিজে বিরাট কোহলির দলকে ৪–১ ব্যবধানে হারিয়েছিল এই রুটেরই ইংল্যান্ড। দেশের মাটিতে নেতা রুটের পরিসংখ্যানও বেশ ভাল। পাঁচ সিরিজে জয়, দুই সিরিজে হার।

কী আশ্চর্য, যাঁরা নেতা রুটের সমালোচনায় দিন–রাত এক করছিলেন, তাঁরাই এখন ব্যাটার রুটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লর্ডসে শুধু ম্যাচ জেতানো অপরাজিত তিন অঙ্কের রানই করেননি, বিশ্বের ১৪তম ব্যাটার হিসেবে রুট ঢুকে পড়েছেন টেস্টের দশ হাজারি ক্লাবেও। সেই তালিকায় কুক ছাড়া তিনি দ্বিতীয় ইংরেজ। লর্ডসে রুটের ব্যাটিং দেখে কুক বলেছেন, ‘‌সবথেকে অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলতে দেখেছি কেভিন পিটারসেনকে। কিন্তু আমার দেখা সবথেকে কমপ্লিট ইংরেজ ব্যাটসম্যান হল জো রুট।’‌ 

রুটের পাশে লেখা ১০,০১৫ রান। শীর্ষে শচীন তেন্ডুলকার (‌১৫,৯২১)‌। প্রাক্তন অসি অধিনায়ক মার্ক টেলর মনে করছেন ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তির রেকর্ড ভেঙে দেবেন রুট। টেলরের এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। গত দেড় বছরে টেস্টে ফ্যাব ফোরের মধ্যে তুলনামূলক ছবিটা দেখলেই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২১–এর ১৩ জানুয়ারি রুটের রান ছিল ৭,৮২৩, সেঞ্চুরি ১৭। স্মিথের ৭,৪৪৯, সেঞ্চুরি ২৭। বিরাটের ৭,৩১৮, সেঞ্চুরি ২৭। কেন উইলিয়ামসের ৭,১১৫, সেঞ্চুরি ২৪। আর লর্ডসে ইংল্যান্ড–নিউজিল্যান্ড টেস্ট শেষের পর ২০২২–এর ৫ জুনে রুটের মোট রান ১০,০১৫, সেঞ্চুরি পৌঁছে গেছে ১৭ থেকে ২৬–এ। বাকি তিনজন কোথায়? বিরাট, স্মিথ, কেনের সেঞ্চুরি একটাও বাড়েনি। তাঁদের রান যথাক্রমে ৮,০৪৩, ৮,০১০, ৭,২৮৯। 

বোঝাই যাচ্ছে নেতা রুটের ব্যাটে রানের খরা ছিল না। খামতি তৈরি হচ্ছিল নেতৃত্ব দেওয়ায়। আবার এটাও ঠিক, নেতৃত্বের বোঝা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে। সেটা রুটও স্বীকার করে বলেছেন, ‘পারছিলাম না এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে। এমনকী, এই ব্যাপারটা পরিবারের মধ্যেও প্রভাব ফেলছিল, যা কখনই কাম্য ছিল না।’‌ অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন, অনবদ্য ইনিংসে আবার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে জো বুঝিয়েছেন তাঁর ‘‌শিকড়’ অনেক গভীরে। ‌‌