সালটা ১৯৫৬। সেবার অস্ট্রেলিয়া এসেছে ইংল্যান্ড সফরে। সারে কাঊন্টির বিপক্ষে খেলা। সারের তখন দারুণ টিম। টানা ৫ বার কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়ে গেছে। টিমের এক নম্বর অফ স্পিনারটি কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। তার অবশ্য একটা স্পষ্ট কারণও ছিল। ১৯৪৮ সালে ডন ব্র্যাডমানের ‘অপ্রতিরোধ্য’ অস্ট্রেলিয়া টিমের বিপক্ষে বিশেষ সুবিধা করতে না পারার ফলে ইংল্যান্ডের দল থেকেই বাদ পড়ে যান। সেই অস্ট্রেলিয়া, সেই প্রতিপক্ষ, আবার সামনে। বোলিং স্কিলের সঙ্গে যুক্ত হল তীব্র জেদ। মারাত্মক অফ-স্পিনের মুখে অস্ট্রেলিয়া অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল। এক ইনিংসে একাই ১০ উইকেট তুললেন তিনি। ১৮৭৮ সালের পরে সেই প্রথম সকলে অবাক-বিস্ময়ে দেখল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ইনিংসে ১০ উইকেট তোলা যায়। সংবাদমাধ্যম চিনে নিল জিম চার্লস লেকার নামের এই চতুর অফস্পিনারকে।
কিন্তু ওখানেই থামেননি তিনি। ক’টা দিন বাদেই টেস্টে আবার মুখোমুখি হলেন অজিদের বিরুদ্ধে ওল্ড ট্রাফোর্ডে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া একটা সময় ছিল ৬২/২। ভাবা যায়, লেকার বোলিং-প্রান্ত বদল করতেই গোটা টিম হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল ৮৪ রানে! একটা স্পেলে মাত্র ২২ বলে ৮ রানে ৭ উইকেট তুললেন লেকার। ইনিংসে পেলেন ৩৭ রানে ৯ উইকেট! কিন্তু তখনও বিস্ময়ের বাকি ছিল অনেকটাই।ফলো-অনের পরে অস্ট্রেলিয়া লড়াই করতে করতে পৌঁছয় ১১৬/২।
ইতিমধ্যে বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে অনেকটা সময়। আর বড়জোর কয়েক ঘন্টা কাটাতে পারলেই ম্যাচ ড্র। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক পিটার মে তাঁর যাবতীয় আভিজাত্যের অহংকার সরিয়ে জেতার আশায় বল তুলে দিলেন লেকারের হাতে। অনমনীয় চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে লেকার আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে যে কান্ডটি ঘটালেন, এই গ্রহের মানুষ তা আগে কখনও টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যক্ষ করেনি। প্রথম ইনিংসে একটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তাঁরই সারে কাউন্টির সঙ্গী বাঁ-হাতি স্পিনার টনি লক। দ্বিতীয় দফায় আর ৯টি নয়, একাই ৫৩ রানে ইনিংসে ১০ উইকেটই তুলে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন। টেস্টটার নামই হয়ে গেল ‘লেকার্স টেস্ট’। ক্রিকেটের ইতিহাসে এক টেস্টে একাই ১৯ টি উইকেট দখল করার কীর্তিটি আজও অস্পর্শিত।
অজস্র ভালোবাসা আর অভিনন্দনে আপ্লুত লেকারের সে’দিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। তাঁর অস্ট্রেলিয়ান স্ত্রী ‘লিলি’ ক্রিকেট খেলাটা ঠিক বুঝতেন না। স্বামীকে দেখে লিলি জিজ্ঞাসা করলেন “জিম, তুমি কি আজ মাঠে কিছু করেছো? অনেক অপরিচিত মানুষ তোমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানাচ্ছিল।” লেকার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। বালিকার সরলতা লিলির দু’চোখের তারায় ছায়া মাখিয়ে রেখেছে। কোনও অনুযোগ নয়, মাঠের যুদ্ধ মাঠেই শেষ করে-আসা মানুষটি মৃদু স্বরে শুধু বললেন “চলো, ডিনারটা সেরে নিই। আজ খুব টায়ার্ড লাগছে।” যে লোক ১৯৪৮ সিরিজে নিয়েছিলেন মাত্র ৯ উইকেট, সেই লেকারই ‘অ্যাশেজ’ সিরিজে ৪৬ উইকেট নিয়ে গড়লেন নতুন রেকর্ড। কিন্তু কর্তাদের সঙ্গে তাঁর মন কষাকষি চলছিলই। ‘ওভার টু মি’ বইতে খোলাখুলি লিখলেন, “শুধু অভিজাত লোকের জন্য নয়, ক্রিকেটারদের দলে ঢোকার মাপকাঠি হোক একমাত্র যোগ্যতা।” সেই যুগে এসব কথা লিখিতভাবে জানালে যা হওয়ার তাই হল। যে ‘সারে’-কে বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন করেছেন, তারাই তাঁর মাঠে ঢোকার ‘ফ্রি’-এন্ট্রি পাস বন্ধ করে দিল! এমসিসি বাতিল করল তাঁর ‘সাম্মানিক’ সদস্য পদ!
জীবনে অনেক দুর্বোধ্য ২২ গজ থেকে অনেক রহস্য উদ্ধার করে ৪৬ টেস্টে ১৯৩ উইকেট আর প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ১৮.৪১ গড়ে ১৯৪৪ টি উইকেট পেলেও নিজের অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পথটা খুঁজে পাননি তিনি। গল-ব্লাডার অপারেশনের পরে সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত বরেণ্য স্পিনার জিম চার্লস লেকার ১৯৮৬ সালের আজকের তারিখে (২৩ এপ্রিল) মাত্র ৬৪ বছর বয়সে চিরতরে পাড়ি দেন সেই দেশে, যেখানে সূর্যাস্ত হয় না।