৫০-এ পা রাখলেন শচীন

তাঁকে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে যাওয়া একটি কাহিনী অনেকেরই জানা। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান একবার বলেছিলেন যে, ভারতকে আক্রমণ করার সেরা সময় যখন শচীন তেন্ডুলকার ব্যাটিং করেন, কারণ সারা ভারত তখন শচীনকে দেখতে ব্যস্ত থাকে। ভারতীয় ক্রিকেট আর ভারতকে সমার্থক করে দিয়েছিলেন তিনি, শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।যাকে ভালবেসে শচীন, সচ্, তেন্ডলা, সাচ্চু, ছোটবাবু ইত্যাদি নানাবিধ নামে ডেকে থাকেন ভারতীয় ক্রিকেটরসিকরা।


তবু, কত কথা যে কথকতায় কত ভাবে ছড়িয়ে দিত কত লোক! মূল বক্তব্য, কেন শচীন “রিটায়ার” করছেন না? কেন? কেন? কেন? সে সব কথার জবাব ছিল শচীনের ব্যাটে। যে ব্যাটে ২০০টি টেস্ট আর ৪৬৩টি ওডিআইতে এসেছিল মোট ৩৪,৩৪৭ টেস্ট আর ওডিআই রান আর ১টি টি২০তে ১০ রান। যার মধ্যে ছিল ১০০টি শতরান আর ১৬৪টি অর্ধশতরানও। কারণ, শচীন জানতেন “কথায় কথা বাড়ে”। তাই কথা বলতেন শুধু নিজের ব্যাটে। আর ওই রানগুলো শুধু শচীনের ব্যাটের অর্জন ছিলনা, ছিল প্রতিটি ভারতবাসীর মনে মনে জন্মানো ইচ্ছাশক্তির গর্বিত অর্জন। স্লো স্পিন বলে ৪৬টি টেস্ট উইকেট আর ১৫৪টি ওডিআই উইকেটও তাঁর নামেই লেখা আছে রেকর্ড খাতায়।


১৯শে মে ১৯৯৯ তারিখে, ৬৫ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক রমেশ তেন্ডুলকরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বিশ্বকাপের ভারত-জিম্বাবোয়ে ম্যাচ স্কিপ করে লেস্টারশায়ার থেকে মুম্বাই উড়ে এসেছিলেন তাঁর বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ছেলে, তাঁর অন্তিম সংস্কারে অংশ নিতে। প্রথম দুটি ম্যাচে হেরে যাওয়া ভারত খুব খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে, এই অবস্থায় তাঁর মায়ের কথায়, অন্তিম সংস্কারের পরেই সেই বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ছেলে আবার ফিরে গিয়েছিলেন ব্রিস্টলে, পরের ম্যাচেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে খেলার জন্য। আর সেই ম্যাচে করেছিলেন এক অবিস্মরণীয় অপরাজিত ১৪০, যা ছিল তাঁর বাবার জন্য উৎসর্গীকৃত। শেষ অবধি সেবারের বিশ্বকাপে “গ্রুপ অফ সিক্স”-এ উঠে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিল ভারত। এই ফল যেটা জানায় না, তা হল শচীনের টিমের প্রতি কমিটমেন্ট। কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৪০ রান করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকেই হয়ত খুঁজেছিলেন তিনি সেদিন। তাঁর মধ্যে মূল্যবোধ রোপণের স্থপতি ছিলেন তাঁর বাবা রমেশ তেন্ডুলকার, মানসিক কাঠিন্য এনে দিয়েছিলেন তাঁর মা রজনী তেন্ডুলকার (ছোটবেলায় তাঁর শটে নাক ফেটে যাবার পরেও খেলায় উৎসাহ দেওয়া) আর আগলে রাখা তিনি শিখেছিলেন দাদা অজিত তেন্ডুলকারের কাছ থেকে। আর তাঁর ক্রিকেটে ব্যাটিং অস্ত্রাগারের প্রতিটি অস্ত্র ক্ষুরধার করে তুলতে শিখিয়েছিলেন কোচ রমাকান্ত আচরেকার। যাঁর মৃত্যুর পরে কফিন বহনকারীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।


৬টি বিশ্বকাপ খেলা, ২০০টি টেস্ট আর ৪৬৩টি ওডিআই তাঁর মত আর কেউ ভবিষ্যতে খেলবেন কিনা অথবা তাঁর করা ৬টি বিশ্বকাপ শতরান পেরিয়ে ৭টি বিশ্বকাপ শতরান আর কেউ করবেন কিনা (আপাতত পড়ুন রোহিত শর্মা) তা তর্কের বিষয়। তবে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে একথা বলে দেওয়া যায় যে, টেস্টে ১৫,৯২১টি রান, ৫১টি শতরান আর ৬৮টি অর্ধশতরান, সঙ্গে ৪৬টি উইকেট আর ১১৫টি ক্যাচ এবং ওডিআই-তে ১৮,৪২৬টি রান, ৪৯টি শতরান আর ৯৬টি অর্ধশতরান সঙ্গে ১৫৪টি উইকেট আর ১৪০টি ক্যাচ, অন্য কোন ব্যাটার অথবা অন্য কোন বোলার কিংবা অন্য কোন ফিল্ডার (উইকেটরক্ষক বাদ দিয়ে) নিজের নামের পাশে রাখতে পারবেন না।

সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের নাম ভারতের ক্রিকেট মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল ১৯৮৮র ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে, ১৯৮৮র হ্যারিস শিল্ড সেমিফাইনালে তাদের সেন্ট জেভিয়ার্স হাইস্কুলের (ফোর্ট) বিরুদ্ধে ম্যাচের পরে। সে ম্যাচে অপরাজিত ৩২৬ রান (৪৮X৪, ১X৬) করা ১৪ বছরের শচীন তেন্ডুলকার আর অপরাজিত ৩৪৯ রান (৪৯X৪, ৪X৬) করা ১৬ বছরের বিনোদ কাম্বলি ৩য় উইকেটের জুটিতে করেছিলেন অবিচ্ছেদ্য ৬৬৪ রানের তখনকার বিশ্বরেকর্ড। এই ম্যাচটিই ছিল এই দুজনেরই ক্রিকেটের বৃহত্তর জগতে প্রবেশের সিংহদরজা। এই ম্যাচটি পরের মরশুমেই রণজি ট্রফিতে মুম্বাই টিমে সুযোগ করে দেয় শচীনকে যদিও কম বয়সের জন্য চূড়ান্ত একাদশে স্থান হয়নি তাঁর। আর সেটাই ছিল রণজি ট্রফিতে মুম্বাইর হয়ে সানি গাভাসকারের শেষতম মরশুম। এক বছর পরেই ১৯৮৯র পাকিস্তান সফরে ভারতীয় দলে জায়গা পান তিনি।

১৫ নভেম্বর তারিখটা তাঁর জীবনে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জীবনের প্রথম টেস্ট খেলার প্রথম দিন ও তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট খেলার শেষ দিন, দুটোই ছিল ১৫ নভেম্বর, যথাক্রমে ১৯৮৯ আর ২০১৩। মাঝের ২৪ বছরে কত কত কীর্তির মিনার যে গড়ে দিয়ে গেছেন তিনি! প্রথম টেস্টেই ওয়াকার ইউনিসের বলে চোট পাওয়া, তা উপেক্ষা করে খেলে যাওয়া। রান করেছিলেন মাত্র ১৫। ওই সিরিজেই এক প্রদর্শনী কুড়ি ওভারের ম্যাচে আবদুল কাদিরকে বেধড়ক মারাটা তো আজ ইতিহাস। তারপরে কিছুদিনের মধ্যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট শতরান (জীবনের প্রথম ৪টি টেস্ট শতরানই ছিল বিদেশের মাটিতে), ১৯৯৯-তে চেন্নাইর ১৩৬, ২০০২-এ নাগপুরের ও কলকাতার ১৭৬, ২০০২-এ লীডসের ১৯৩, ২০০৪-এ সিডনির অপরাজিত ২৪১, মুলতানের অপরাজিত ১৯৪, ঢাকার অপরাজিত ২৪৮, ২০০৮-এর এডিলেডের ১৫৩ আরো অজস্র সোনার ইনিংস তিনি উপহার দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে। কলকাতার ২০০১-এর ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়া টেস্ট জয়ে তাঁর ২য় ইনিংসের বোলিংয়ের অবদান ছিল অনেকটাই। তবু তিনি শুনে গেছেন, অধিকাংশ ভারতীয় জয়ে তার অবদান নাকি নগণ্য ছিল। জীবনের শেষ টেস্টে মুম্বাইতে একমাত্র ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিনি ৭৪ রান করেছিলেন।


আর ওডিআই-তে ১৯৯৩-এর হিরো কাপের ফাইনালে তাঁর শেষ ওভারের বোলিং, ১৯৯৪য়ে প্রথমবার ওপেন করে কিউয়িদের বিরুদ্ধে ৮২ (৪৯ বলে), ১৯৯৬ বিশ্বকাপে দিল্লীতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৩৭, ১৯৯৮-তে শারজায় উপর্যুপরি ২ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তোলা বিখ্যাত মরুঝড় (১৪৩ ও ১৩৪), ২০০৪-এ রাওয়ালপিন্ডির ১৪১, ২০০৯-এ ক্রাইস্টচার্চের অপরাজিত ১৬৩, ২০০৯-এ হায়দ্রাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৭৫ আর ২০১০-এ গোয়ালিয়রে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অপরাজিত ২০০ অমর হয়ে আছে ক্রিকেটমনস্কদের মননে। ৪টি বিশ্বকাপে (১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০১১) তাঁর পারফরমেন্স আজ ইতিহাস। এর মধ্যে ২০০৩ আর ২০১১-তে ফাইনালে খেলেছিল ভারত, জিতেছিল ২০১১-তে।২০০৩-এ পাক আক্রমণকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁর ৭৫ বলে ৯৮ আজও অন্যতম সুখস্মৃতি।

খেলার মত খেলার বাইরেও এক অনন্য অবদান রাখেন তিনি। শিশুদের হৃদযন্ত্রঘটিত রোগের চিকিৎসার জন্য মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে অর্থপ্রদান, মুম্বাইয়ে প্রতি বছর লিটল হার্টস ম্যারাথনের উদ্যোগ নিয়ে একই উদ্দেশে ওই হাসপাতালেই অর্থ যোগানো, প্রতি বছর  “আপনালয়” এনজিও-র মাধ্যমে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দুশো শিশুর অর্থনৈতিক উত্তোলনের দায়িত্ব নেওয়া, ক্যানসার নামক ঘাতকব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য উদ্যোগ নিয়ে অর্থ তুলে দেওয়া এবং আরো অজস্র জনহিতকর কাজে জড়িয়ে থাকা শচীন ভারতীয় ক্রিকেটের মত বৃহত্তর সমাজেও আদর্শই থেকে গেছেন আজও।

এখন ক্রিকেট আর “সেই ক্রিকেট” নয় অনেকের কাছেই, ১৫.১১.২০১৩ তারিখটার পরে। আর যে ক্রিকেটের শুরু ছিল ১৫.১১.১৯৮৯ তারিখে আর চলেছিল পাক্কা ২৪ বছর। তখন হেলমেট শুধু নয়, শচীনের ব্যাটেও জড়ানো থাকত অদৃশ্য কিন্তু অনুভব করতে পারা ভারতের জাতীয় পতাকা আর দেশের হয়ে করা তাঁর প্রতিটি অর্জন শোনাত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। আজও তাঁর সম্মোহনে সম্মোহিত আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের ক্রিকেট জনতা। শচীনের মহিমায় আজও সযত্নে ঢাকা ভারতীয় ক্রিকেট আর ভারত। এক নয়, দুই নয়, চব্বিশটা বছর (১৯৮৯ – ২০১৩) এটা জানে রানে রানে। একশ-র একশ কিছু তো বটেই। যেটা আজও অধরাই।

২৪ বছর প্রতিটি ভারতবাসী আপনার দিকে ধেয়ে আসা প্রতিটি ডেলিভারি খেলেছে, শতরান থেকে শূন্যরান করেছে, সাফল্যে হেসেছে, ব্যর্থতায় ভেঙ্গেছে, আপনারই সঙ্গে সঙ্গে। আজও আপনি তাদেরই সঙ্গে, তাদের বুকের ভিতরে।

ক্রিকেট ছাড়ার পর আট বছর অতিক্রান্ত। এখনো আপনার ফেলে আসা স্ট্রেট ড্রাইভগুলি সোজা রাখে ভারতবাসীকে। এখনো আপনার ফেলে আসা হুকগুলি মনে রেখে জীবনের বাউন্সার সামলায় ভারতীয় জনতা। আপনার ফেলে আসা ফ্লিকগুলি সম্বল করে দুঃখকষ্টকে বাউন্ডারীতে পাঠায় ভারতীয় আমজনতা, এখনো। ভারতকে এখনো একাত্ম রাখেন আপনি। আপনার ক্যারিশমায়।

আমার মত অনেকেরই জীবনের ৩১ থেকে ৫৫, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমী রোদঝরা দুপুরের সময়টা যে আপনার ব্যাটের ঠান্ডা ছায়াতে ঢাকা আছে, তার অনেক অসহায় সাক্ষীদের মধ্যে থেকে গেছেন ওয়াসিম আক্রম থেকে ওয়াকার ইউনুস হয়ে স্টিভ ওয়াগ, শেন ওয়ার্ন থেকে শোয়েব আখতার হয়ে শন পোলক, কোর্টনি ওয়ালশ থেকে কার্টলে অ্যামব্রোস হয়ে ক্রিস কেয়ার্নস, সনথ জয়সূর্য থেকে সাকলিন মুস্তাক হয়ে শেন বন্ড, মুথাইয়া মুরলীধরণ থেকে মাখায়া এনটিনি হয়ে মার্কোস ট্রেসকোথিক, হেনরি ওলোঙ্গা থেকে হিথ স্ট্রিক হয়ে হ্যানসি ক্রোনিয়ে, গ্রাহাম থর্প থেকে গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার হয়ে গ্লেন  ম্যাকগ্রাথ, আকিব জাভেদ থেকে অ্যালান ডোনাল্ড হয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ এবং আরো কতজন যে! শচীনের নিজের কথায়, হ্যানসি ক্রোনিয়ে আর গ্লেন ম্যাকগ্রাথের সাথেই তাঁর টক্করটা হত সেয়ানে সেয়ানে। আমাদের বাঁচা সার্থক যে আমাদের সেই সময়ে আপনি ব্যাট হাতে ভারতের ক্রিকেটকে আগলেছিলেন এবং আমাদের চোখগুলো সেটা দেখার জন্য খোলা ছিল।

ভালো থাকুন, মনে থাকুন, মননে থাকুন।

যেমন আছেন এখন।

জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিন, শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।