৬৭তে পিটার জেফ্রি লেরয় ‘দুজন’

মজা করে তাঁর ব্যাপারে বলা হত – একজন নয়, “দুজন”। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডান-হাতি উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান পিটার জেফ্রি লেরয় দুজোঁ আসলে একজন নন, “দুজন”। মাঝে মাঝে অবশ্য তাঁর খেলা দেখলে এটাই সত্যি বলে মনে হত যে দুজনের একজন উইকেটকিপার, অন্যজন ব্যাটসম্যান। বিশুদ্ধবাদীরা তার পদবীর উচ্চারণ দুজোঁ (বা ডুজন) করলেও আমরা কিন্তু খুশী ছিলাম “দুজন”-এই। শুরুতে বলা হয়ত মজাটুকুর জন্যই।

ক্রিকেট-বিশ্ব এবং অবশ্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যা খুশি করার, মাত্র দশ বছরেই করে গেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। যাকে ব্যাটসম্যান-উইকেটকিপারও বলা যেত স্বচ্ছন্দে। তিনি ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৮১ থেকে ১২ই আগস্ট ১৯৯১ এই সময়ের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলে ফেলেছিলেন ৮১টি টেস্ট। আর ৫ই ডিসেম্বর ১৯৮১ থেকে ২২শে অক্টোবর ১৯৯১ এই সময়ের মধ্যে দেশের হয়ে তিনি খেলে দিয়েছিলেন ১৬৯টি ওডিআই ম্যাচ। এরই মধ্যে ১৯৮৯-এর “উইসডেন ক্রিকেটার অফ দি ইয়ার” নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

অর্থাৎ তিনি গড়ে বছরে ৮টি টেস্ট আর ১৭টি ওডিআই ম্যাচ প্রায়-সমান ধারাবাহিকতায় একটা নির্দিষ্ট মানে খেলেছেন টানা দশটা বছর ধরে, নতুবা এটা অসম্ভব ছিল। ৮১ টেস্টে মাত্র ১১৫ ইনিংসে (তখন অনেক টেস্টেই ২য় ইনিংসে ব্যাটই করতে হত না তাঁকে, এতটাই অবিসংবাদী আধিপত্য ছিল তখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের) ৫টি শতক ও ১৬টি অর্ধশতকসহ ৩,৩২২ রান ছিল তাঁর ব্যাটে। সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ১৩৯, যেটা করা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে ১৯৮৪-৮৫-তে পার্থের মত দ্রুত আর প্রাণবন্ত পিচে। আর ১৬৯ ওডিআই ম্যাচে ১২০ ইনিংসে তাঁর রান ছিল ১,৯৪৫ (সর্বোচ্চ রান ছিল ৮২*)।

উইকেটকিপিংয়ে ৮১ টেস্টে তাঁর শিকার ছিল ২৭০, যার মধ্যে ক্যাচের সংখ্যা ছিল ২৬৫ আর স্টাম্পিং ছিল ৫টি। তাঁর কেরিয়ারের একদম শুরুর দিকে (দু’টো টেস্টে), যখন ডেভিড মারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেট-রক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন, তখন স্লিপে ফিল্ডিং করেও ২টি ক্যাচ ছিল আজকের আলোচ্য খেলোয়াড়ের, যা তাঁর মোট টেস্ট শিকারসংখ্যাকে নিয়ে যায় ২৭২-এ। আর ১৬৯ একদিনের ম্যাচে তাঁর শিকার ছিল ২০৪, যার মধ্যে ক্যাচ ছিল ১৮৩ আর স্টাম্পিং ছিল ২১। তাঁর কেরিয়ারের সময়কালে দলে স্পিনাররা খুব কমই সুযোগ পেতেন নতুবা নিঃসন্দেহে তাঁর স্টাম্পিং শিকারসংখ্যা হয়ত আরো কিছু বেড়ে যেত। প্রবাদপ্রতিম ফাস্ট বোলারদের বদান্যতায় তখন স্পিনার হওয়াটা রামাধীন-ভ্যলেন্টাইন-গিবস এঁদের অতীতসমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজেও খুব খারাপ “কেরিয়ার অপশন” ছিল। এবং এই কারণেই বিশেষজ্ঞরা আজও বলেন যে স্পিনারদের বিরুদ্ধে তিনি পরীক্ষিত হননি সেভাবে।

যোগ্যতার তুলনায় কিছুটা যেন আন্ডার-রেটেড ছিলেন এই উইকেটকিপার। যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে তাঁর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট কেরিয়ার। ২০০টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ২১টি শতকসহ ৯,৭৬৩ রান ছিল তাঁর আর উইকেটকিপিংয়ে শিকার ছিল ৪৬৯ (৪৪৭ ক্যাচ আর ২২ স্টাম্পিং)। একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাফল্যের পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। যদিও তাঁকে নিয়ে আলোচনাটা নিরুচ্চারেই থাকত, তখনকার অতি বিখ্যাত ব্যাটসম্যান ও বোলাদের তুলনায়। গ্রিনিজ-হেনস-রিচার্ডস-লয়েড-রিচার্ডসন এবং রবার্টস-হোল্ডিং-গার্নার-মার্শাল-প্যাটারসন-ওয়ালশ-অ্যামব্রোজ-বিশপ এঁদের ছায়াতেই অধিকাংশ সময় ঢাকা থেকে যেতেন তিনি।

১৯৮৩-র বিশ্বকাপের বহুচর্চিত ফাইনালে ভারতের ১৮৩-র জবাবে গ্রিনিজ-হেনস-রিচার্ডস-লয়েড-গোমস, এই ৫ জনকে হারিয়ে ৬৬ রানে ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন ব্যাট হাতে নেমে (তখন অন্য প্রান্তে ছিলেন ফাউদ বাক্কাস) দুর্গ বাঁচাতে তাঁর লড়াকু যাওয়া ৭৩ বলে ২৫-এর ইনিংসটা আজও আলোচিত। ২৫ জুন ১৯৮৩-র সেই ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের একমাত্র ওভার বাউন্ডারিটি এসেছিল জেফ্রি দুজনের ব্যাট থেকেই। ফাউদ বাক্কাস আউট হতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৬ উইকেটে ৭৬ হয়ে যাওয়া এবং মার্শালের ক্রিজে আসা। তারপর মার্শালকে সঙ্গে নিয়ে দুজনের ৭ম উইকেটে ৪৩ রানের জুটি কিছুক্ষণের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় শিবিরে। দলের ১১৯ রানের মাথায় মহিন্দার অমরনাথের বলে ‘প্লেড-অন’ হয়ে দুজোঁ ফিরে যেতেই আর ২১ রানের মধ্যে বাকি ৩টি উইকেট তুলে নিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল ভারতীয় দল। তার আগে ভারতীয় ইনিংসে রবার্টসের বলে সানি গাভাসকারের ক্যাচ ধরেছিলেন দুজোঁ।

তাঁর খেলা কোন টেস্ট সিরিজে হারতে হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে, এটা একটা গর্ব করে বলার মত ঘটনা ছিল জেফ্রি দুজোঁর কেরিয়ারে। উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় টেস্ট শিকারের সংখ্যায় (২৭০) এখনো বিশ্বে যুগ্মভাবে ব্র্যাড হ্যাডিনের সঙ্গে ৬ নম্বরে আছেন তিনি, বাউচার, গিলক্রিস্ট, হিলি, মার্শ ও ধোনির পরেই। অন্যদিকে উইকেটরক্ষকের ভূমিকাতেই টেস্ট ক্যাচের সংখ্যায় (২৬৫) এখন বিশ্বে তাঁর স্থান ৫ নম্বরে, বাউচার, গিলক্রিস্ট, হিলি আর মার্শের পরেই। এক টেস্ট সিরিজে ৩ বার (ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৮৩-৮৪, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৮৪-৮৫ আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৮৮তে) তিনি ছিলেন ৩০০+ রান ও ১৫+ শিকারের মালিক। পুরো কেরিয়ারে উইকেটরক্ষক হিসেবে শিকার (৪৭৪) এবং ক্যাচের (৪৪৮) সংখ্যা, দুটি ক্ষেত্রেই জেফ্রি দুজোঁ এখন বিশ্বে ৮ম স্থানাধিকারী।

ইয়ান হিলিকে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের চেয়ে বড় উইকেটকিপার মানতেন জেফ্রি দুজোঁ, শুধু শেন ওয়ার্নকে অনেক বেশি ভালভাবে সামলাবার জন্য। অবসরের পরে জাতীয় দলের সহকারী কোচ হয়েছিলেন তিনি। ধারাভাষ্যকার হিসেবেও নিজের একটা আলাদা মান ধরে রেখেছিলেন ২৮শে মে ১৯৫৬ তারিখে জামাইকার কিংস্টনে জন্মগ্রহণ করা জেফ্রি দুজোঁ।

আজ ৬৭তে পা দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই “আনসাং হিরো”। ভাল থাকবেন, জেফ্রি দুজোঁ। আপনার কেরিয়ারের মতন।শুভ জন্মদিন, বিশ্ব ক্রিকেটের উইকেটকিপিংয়ের মিষ্টি রোমান্টিক মৃদু হাওয়া পিটার জেফ্রি লেরয় দুজোঁ।