এল-বি-ডব্লিউ-এর কড়াকড়ি না ছড়াছড়ি – এই নিয়েই লড়ালড়ি!

টেস্ট-ক্রিকেটে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক এল-বি-ডব্লিউ (LBW) আউট হয়েছেন সাতজন ব্যাটার – ২০০৩ সালের জুন মাসে চেস্টার-লে-স্ট্রিট টেস্টে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিম্বাবোয়ের প্রথম ইনিংসে, এবং ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে। ২৮ বার এক ইনিংসে ছ’জন ব্যাটার LBW হয়েছেন – ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে – তার মধ্যে ১৭ বার এই শতাব্দীতে।

টেস্ট-ক্রিকেটে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক এল-বি-ডব্লিউ (LBW) আউট হয়েছেন ২০ জন ব্যাটার – ২০১১ সালের মে মাসে গায়ানা টেস্টে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে। এক ম্যাচে ১৭ জন ব্যাটার LBW হয়েছেন এমন ঘটেছে দু’বার, ১৬ জন হয়েছেন একবার, ১৫ জন পাঁচবার, ১৪ জন সাতবার, ১৩ জন ন’বার – ১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে – (২৫ বারের মধ্যে) ১৭ বার এই শতাব্দীতে।

অর্থাৎ এই শতাব্দীতে ব্যাটারদের LBW আউট হওয়ার ঘটনা কী বেড়েছে? (সত্যজিৎ রায়-এর “সীমাবদ্ধ” ছবির শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত চরিত্র টুটুলের সংলাপে, “সেটা ভাল না খারাপ?” কঠিন প্রশ্ন!

যেকোনও স্তরে/পর্যায়ে নিজে ক্রিকেট খেলেন/খেলেছেন, বা নিয়মিত ক্রিকেট খেলা দেখেন/দেখেছেন, এমন মানুষদের মধ্যে কতজন নিজের অথবা নিজের সমর্থিত দল বা প্রিয় খেলোয়াড়ের LBW হওয়ার/দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অখুশি হননি/হননা? ক্রিকেটের ঘোরতর অপছন্দের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম, বোধহয় এক নম্বরেই আছে। খুব ভুল বলছি কী? তাহলে এই বহু-বিতর্কিত ক্রিকেটীয় ব্যাপারটাকে নিয়ে আজকে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে

যতদূর জানা যায়, ১৭৪৪ সালে সর্বপ্রথম লিখিত ক্রিকেটের আইনে LBW ছিলনা – তখনকার বাঁকানো ব্যাট দিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ব্যাটাররা উইকেটের সরাসরি সামনে দাঁড়াতে পারতেন না বলেই হয়ত তার দরকার ছিলনা। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যাট সোজা হতে শুরু করল (সঙ্গের ছবিটা দেখুন) আর ব্যাটাররা ক্রমশ উইকেট ঘেঁষে দাঁড়াতে লাগলেন। কিছু কিছু ব্যাটার আরম্ভ করলেন ইচ্ছে করে পা দিয়ে উইকেট-মুখো বল আটকানো। ফলে, ১৭৭৪ সালে আইন বদল করে ইচ্ছাকৃতভাবে উইকেট-মুখো বল পা দিয়ে আটকালে ব্যাটারকে আউট দেওয়ার নিয়ম যোগ করা হয়। ‘বেচারা’ আম্পায়ারের ওপরেই দায় ছিল ব্যাটারদের এই (বদ) ‘ইচ্ছা’-টা নির্ধারণ করবার – ঝামেলা আর কাকে বলে!

১৭৮৮ সালে আম্পায়ারদের এই ঝকমারি কমাবার জ্ন্য নিয়ম করা হয়: “(It was) no longer required (by) the umpires to take account of the batsman’s intent; now a batsman was LBW if he stopped a ball that ‘pitch[ed] straight.’” এরপর, ১৮২৩ সালে একটি শর্ত যোগ হয়: “… the ball must be delivered in a straight line to the wicket.” ঝঞ্ঝাট বাধল যখন দু’জন (তৎকালীন) বিশিষ্ট আম্পায়ারের মধ্যে মতানৈক্য হয় এই নিয়ে যে বলটা বোলারের হাত থেকে উইকেটের দিকে, অথবা পিচের দুই প্রান্তের উইকেটদ্বয়ের মধ্যে, সরলরেখায় (in a straight line) যেতে হবে কিনা! ১৮৩৯ সালে – ততদিনে Marylebone Cricket Club (MCC) আইনের রক্ষক হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত – নির্ধারিত হয় “… ruled the batsman out LBW if the ball pitched in between the wickets and would have hit the stumps.

মোটের ওপর, LBW-র নিয়ম ১৮৩৯ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, প্রায় এক শতাব্দী ধরে, প্রায় অপরিবর্তিতই ছিল, যদিও কিছু কিছু প্রস্তাব/দাবি উঠেছিল তা পাল্টানোর জন্য। এর একটা বড় কারণ ছিল অসুবিধেয় পড়লেই কিছু ব্যাটারের ব্যাটের বদলে প্যাড দিয়ে বল আটকানো – এর চলতি নাম ‘pad play’ – যা নাকি নামী খেলোয়াড়দের মধ্যে আর্থার শ্রিউসবেরি (সঙ্গের ছবিটা দেখুন) মাঝেমধ্যেই ব্যবহার করতেন। ইতিমধ্যে পিচগুলোর অবস্থার বেশ কিছু উন্নতি হওয়ায় ব্যাটিং আগের থেকে কিছুটা সহজতর হয়, রান বেশি ওঠা শুরু হয় এবং খেলায় ভারসাম্যের একটা অভাবের অনুভূতি তৈরি হ’তে থাকে।

প্যাড-প্লে সমস্যার বাড়াবাড়ি আটকাতে ১৮৮৮ সালে প্রস্তাব ওঠে: “… the batsman would be out if he stopped a ball that would have hit the wicket; … this took no account of where the ball pitched relative to the wickets.” কিন্তু নিয়মের কোনও বদল হয়নি, যদিও MCC এক ‘নিন্দাপ্রস্তাব’ আনে এইধরণের প্যাড-প্লে-র বিরুদ্ধে। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত নিন্দাপ্রস্তাবেরই মতন, এতে কোনও কাজের কাজ হয়নি! বোলারদের ওপর ব্যাটারদের ‘অন্যায্য আধিপত্য’ কমাবার জন্য আনা (বাতিল-হওয়া) অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে এমনকি উইকেটের আকার বাড়াবার প্রস্তাবও ছিল!

বিংশ শতকে

১৯০২ সালে MCC-র এক বিশেষ সাধারণ সভায় এই ১৮৮৮ সালের প্রস্তাবটা নিয়ে ভোটাভুটিও হয়। তৎকালীন বিখ্যাত খেলোয়াড় অ্যালফ্রেড লিটলটন এটা সমর্থন করেন কিন্তু আরেক বিখ্যাত খেলোয়াড় অ্যালান স্টীল করেন বিরোধিতা – ২৫৯-বনাম-১৮৮ ভোটে প্রস্তাবটা সমর্থিতও হয়, কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে নিয়মটা একই থেকে যায়।

ব্যাটারদের মধ্যে এই প্যাড-প্লে-র ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার একটা সংখ্যাগত প্রতিফলন দেখা যায়। ১৮৭০-এর দশক থেকে ধরলে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে আউটের মধ্যে LBW আউটের অনুপাত ছিল – ১৮৭০-এ ২%, ১৮৯০-এ ৬%, এবং ১৯২৩-এ ১২% – ক্রমশ ঊর্দ্ধগামী।

১৯০০ থেকে ১৯৩০ এই তিন দশকের মধ্যে ব্যাটারদের করা রানসংখ্যা এবং LBW আউটের অনুপাত দুইই বাড়তে থাকে, সঙ্গে প্যাড-প্লে নিয়ে বোলারদের মধ্যে বিরক্তি-হতাশা-ক্ষোভও। কিছু কিছু ব্যাটার অফ-স্টাম্পের বাইরে-পিচ-পড়া বল পা বাড়িয়ে লাথি মেরে সরাতেন, এই জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে যে এতে তাঁরা LBW হবেননা। MCC-র কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারেন যে এইসব ব্যাপারের জন্য খেলার বিনোদন মার খাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলেন যে (লেগ-স্টাম্প-ঘেঁষা শরীর-তাক-করা) বডিলাইন বোলিংয়ের উদ্ভাবনের এটা একটা বড় কারণ। ১৯৩৩ সালে, বডিলাইন বিতর্কের বাড়াবাড়ির সময় স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যান, যিনি নাকি বডিলাইন বোলিংয়ের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন, MCC-কে লেখেন খেলায় আরো উত্তেজনা আনবার জন্য LBW-র নিয়ম বদল করতে।

MCC-ও চেষ্টা করে যাচ্ছিল – ১৯২৭ সালে বলের আকার হ্রাস করা হয় ও ১৯৩১ সালে স্টাম্পের আকার বৃদ্ধি করা হয়, যদিও তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। ১৯৩৫ সালে, পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এই নিয়ম: “… the batsman could be dismissed lbw even if the ball pitched outside the line of off-stump – in other words, a ball that turned or swung into the batsman but did not pitch in line with the wickets. However, the ball was still required to strike the batsman in line with the wickets.” – একটু চেনা-চেনা ঠেকছে কি! ১৯৩৫ সালে কাউন্টি-ক্রিকেটে ১,৫৬০টা LBW-আউটের মধ্যে ৪৮৩টা (প্রায় ৩১%) এই পরিবর্তিত নিয়মে দেওয়া হয়। কিছু নামী ব্যাটারের (যেমন হার্বার্ট সাটক্লিফ, এরল হোমস, বব ওয়্যাট) আপত্তি এবং অস্ট্রেলীয় কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সালে, এই ‘নতুন’ জিনিসটা ক্রিকেটের আইনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। 

এই বদলটা খেলায় উত্তেজনা ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছিল কিন্তু বাদ সাধল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধশেষে, ১৯৪৬ সালে, অনুশীলনহীন ব্যাটাররা অফ-স্পিন ও (অ্যালেক বেডসারের কায়দার) ইনস্যুইং বোলিংয়ে নাজেহাল হতে লাগলেন। আবার বিতর্ক চালু – ব্যাটারদের অফ-সাইডে শট খেলা কমে যাওয়া নিয়ে। 

১৯৫৬-৫৭ সালে MCC খুঁটিয়ে নজর করে (তৎকালীন) এক প্রচলিত অথচ অ-জনপ্রিয় কৌশল যাতে অফ-স্পিন ও ইনস্যুইং বোলাররা লেগ-সাইডে ভর্তি ফিল্ডার নিয়ে লেগ-স্টাম্প তাক করে বল করতে থাকেন। LBW-র নিয়ম পাল্টে এই সমস্যার সমাধান করবার বদলে MCC লেগ-সাইডে অনুমোদিত ফিল্ডারের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। 

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে প্যাড-প্লে আবার বেড়ে যায়। কারণ? (ব্যাটিংয়ের পক্ষে) কঠিনতর ও অনিশ্চিত ধরণের পিচের সংখ্যার বৃদ্ধি যা ব্যাটিংকে আরো ঝামেলাকর করে তোলে। ১৯৬৩ সালে “দ্য টাইমস” পত্রিকায় প্র্রকাশিত এক রচনায় বলা হয়: “… the law (reduced) the variety of bowling styles. (It) has led to a steady increase in the amount of seam and off-spin bowling. Whereas in the early thirties, every county had a leg-spinner and an orthodox left-arm spinner, leg spinners, at any rate, are now few and far between.

প্যাড-প্লে কমাতে ও লেগ-স্পিন বোলিংকে উৎসাহ দিতে, LBW নিয়মের একটা পরিবর্তন হয়, ১৯৬৯-৭০ সালে। নিয়মটা এইরকম: “,,,a batter would be LBW if a ball destined to hit the stumps pitched in line with the wickets or outside a batsman’s off-stump, and in the opinion of the umpire, he made no genuine attempt to play the ball with his bat. This revision meant that any batter playing a shot could not be out if the ball pitched outside off stump.” – ১৯৩৫-এর নিয়মটার বৈপরীত্যে।

মনে করা হয়েছিল যে এর ফলে ব্যাটাররা আরো বেশি ঝুঁকি নিয়ে শট খেলবেন এবং খেলাটা আরো আকর্ষণীয় হবে। কিন্তু LBW আউটের অনুপাত দ্রুতহারে হ্রাস পেল, এবং অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তারা আরেকটি বদলের প্রস্তাব দিলেন। বেশ প্যাঁচালোভাবে বিবৃত সেই বাক্যগুলোর অর্থ সহজ কথায় হ’ল (১৯৩৫-এর নিয়মটার পরিপ্রেক্ষিতে) “that the batter could now be out even if the ball struck (him) outside the line of off-stump.” এই বাক্যাংশযুক্ত নিয়মটা গোটা ক্রিকেট-বিশ্বে ১৯৭২ সাল থেকে চালু হয়, এবং LBW আউটের অনুপাত (১৯৭০ সালের বদলটার তুলনায়) দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৯৮০ সালে এই নিয়মটা আনুষ্ঠানিকভাবে MCC-র নিয়মে যোগ হয়, এবং (২০১৩ সালেও) এইটাই ব্যবহার হয়ে চলেছে।

উপসংহার

কি, মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে তো! তাও তো ইচ্ছে করেই (১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে লাহোরে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টে প্রথম চালু হওয়া) নিরপেক্ষ আম্পায়ার ব্যবস্থা, এবং বিগত তিন দশক ধরে ক্রমাগত ব্যবহৃত বহুবিধ প্রযুক্তিগত পদ্ধতির (যেমন টিভি রিপ্লে, থার্ড আম্পায়ার, হক-আই, হট-স্পট, স্নিকোমিটার, বল-ট্র্যাকার, ডি.আর.এস ইত্যাদি) কথা মোটেই উল্লেখ করছি না।

শুধুমাত্র LBW নিয়েই খেলার নিয়ামক সংস্থাগুলো (যেমন ICC, MCC) ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আম্পায়ারদের যে কি পরিমাণ মাথা ঘামাতে হতে পারে, এটার সামান্য আভাস পাওয়ার পর আশা করি ক্রিকেটপ্রেমী আমরা আম্পায়ারদের ‘মুন্ডপাত’ একটু কম করব। মনে রাখবেন মাঠে টেস্ট-ম্যাচ চলাকালীন উপস্থিত পনেরোজন (আজকাল ব্যাটারদের রানার পাওয়ার অনুমোদন নেই) ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনঃসংযোগের কাজটা কিন্তু করেন দুই আম্পায়ার, কারণ বাকি তেরোজন খেলোয়াড় প্রত্যেকেই হাঁফ ছাড়বার কিছু না কিছু অবকাশ পেয়ে থাকেন, কেউ বেশি, কেউ কম।