ভাগ্যিস জন রাইট সেদিন চোট পেয়েছিলেন! না হলে কি একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন একটা ‘অভিনব’ পরীক্ষায় সফল হয়ে ওঠার সুযোগ পেতেন নিউজিল্যান্ডের তৎকালীন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো? ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দলেই ছিলেন না তিনি। কিন্তু ওপেনার জন রাইট আহত থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ‘বিশেষ’ নির্দেশসহ বাঁ-হাতি মার্ক গ্রেটব্যাচকে ইনিংসের গোড়াপত্তনে আনেন ক্রো। এবং সেই প্রথম ‘ফিল্ড রেস্ট্রিকশন’-এর সুযোগ কীভাবে সদ্ব্যবহার করতে হয় তার একটি অবিশ্বাস্য ‘উদ্ভাবনী পরিকল্পনা’-র বাস্তবায়ন হতে দেখল ক্রিকেট-বিশ্ব। ডোনাল্ড, স্নেল, ম্যাকমিলানদের বিরুদ্ধে চিরাচরিত ধীরস্থিরভাবে নয়, শুরু থেকেই বেদম পেটাতে শুরু করলেন মার্ক গ্রেটব্যাচ। তখন টি-২০ বা আইপিএল ধামাকা দেখার মতো চোখই তৈরি হয়নি দর্শকের। ফলে ‘ইন-ফিল্ডার’-দের মাথা টপকে নতুন বলকে এইভাবে ‘লিফট’ করাটাকে ব্যাটারের বীরোচিত অসি-আস্ফালন হিসেবেই গণ্য করতে শুরু করল বিমুগ্ধ দর্শককূল। সেই প্রথম ‘পিঞ্চ-হিটার’ শব্দবন্ধটি উঠে এল প্রকাশ্যে। মার্ক গ্রেটব্যাচ সেই ম্যাচে ৬০ বলে ৬৮ করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল ২টি ছক্কা, ৯টি বাউন্ডারি।
বিশ্বকাপ শেষ হল। কিন্তু এই ‘পিঞ্চ-হিটিং’ ব্যাপারটা এক অভিনবত্বের ‘রেশ’ রেখে গেল। অধিকাংশ দেশের মতোই আক্রমণাত্মক ওপেনিং জুটি গড়ায় মন দিল শ্রীলঙ্কাও। গোটা বিশ্ব দেখল, এক বাঁ-হাতি স্পিনার, যে কিছুটা ব্যাটও করতে পারে, সেই সনথ জয়সূর্যকে ১৯৯৩ সালে ‘প্রথম’ ওপেনার হিসাবে পেশ করা হল, ‘হিরো কাপ’-এ। গ্রেটব্যাচ যেখানে শেষ করেছিলেন, অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়িয়ে, সেখান থেকেই একদিনের ক্রিকেটে ‘লাইটনিং ওপেনিং’-এর নতুন প্যাকেজ তৈরি করতে ছোটা শুরু করলেন জয়সূর্য আর তাঁর ডানহাতি সঙ্গী রমেশ কালুভিথর্নে। ক্রমশ অভিজ্ঞ ও মারকুটে হয়ে-ওঠা জয়সূর্যের একটা ইনিংসের কথা মনে পড়ল। ১৯৯৬ সালের আজকের তারিখের (৭ এপ্রিল) ঘটনাটা একটু বলে রাখি। সিঙ্গাপুরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেন জয়সূর্য। প্রথমে ব্যাট করে ইজাজ আহমেদের ৫১ রানের দৌলতে পাকিস্তান তোলে ২১৫। ঝড়ের গতিতে পালটা আক্রমণে নামেন জয়সুর্য। ‘মাতারা হারিকেন’-এর সেই ঝড় কতটা বিধ্বংসী এবং একতরফা ছিল, সেটা বোঝাতেই এই লেখা। শ্রীলঙ্কার প্রথম উইকেট পড়ে ৭০ রানের মাথায়। কালুভিথর্নে ১১ বল খেলে আউট হন ‘শূন্য’ রানে! ভাবতে পারেন, তখন জয়সূর্যের রান কত? ৬৬! না, ভুল পড়ছেন না। বাকি চার রান এসেছে ‘অতিরিক্ত’ থেকে! খানিক আগেই গোটা মাঠকে চরম বিস্মিত করে মাত্র ১৭ বলে ‘ফিফটি’-র হাততালি কুড়োন। শেষমেশ ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ২৮ বলে ৫ টি ছক্কা, আর ৮ টি বাউন্ডারির সাহায্যে অবিশ্বাস্য ২৭১.৪২ স্ট্রাইক-রেটে ৭৬ রান করে জয়সূর্য আউট হন। এর পরেও ম্যাচটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা হারলেও একদিনের ক্রিকেটে ‘দ্রুততম’ ফিফটি হাঁকিয়ে তৎকালীন ‘বিশ্বরেকর্ডটি গড়েন জয়সূর্য (১৬ বলে গড়া বর্তমান রেকর্ডটি এ বি ডিভেলিয়ার্সের দখলে)।
আসলে, টেস্ট হোক বা ওডিআই (পরে টি-২০ খেলেছেন ৩১ টি), সব ধরণের ফরম্যাটেই ওপেনিংয়ের ধারণাটাই আমূল বদলে দেয় জয়সূর্যের আক্রমণাত্মক ব্যাট। বিশেষ করে একদিনের ক্রিকেটে এই মানের ব্যাটার (আসলে অলরাউন্ডার) আজকের দিনেও দুর্লভ। তিনিই বিশ্বে একমাত্র ক্রিকেটার যাঁর সংগ্রহে রয়েছে ১৩ হাজার প্লাস রান, ৩০০ প্লাস উইকেট, ১০০ প্লাস ক্যাচ! ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কা কখনও সেমি-ফাইনালে ওঠেনি। ’৯৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ সনৎ জয়সূর্যের অবদান অনেকটাই। একদিনের ক্রিকেটে একটা সময় ‘দ্রুততম’ ৫০, ১০০, ১৫০ ছিল তাঁরই দখলে। টেস্ট ক্রিকেটেও জয়সূর্যের ব্যাটের ঝলক চোখ ধাঁধিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৯৭ সালে শ্রীলঙ্কা ৯৫২ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস গড়ে, যার মধ্যে জয়সূর্যের ব্যাট থেকে আসে ৩৪০ রানের বিশাল ‘ট্রিপল’ সেঞ্চুরিটি।
রোশন মহানামার সঙ্গে জুটিতে সেই প্রথম টেস্ট ক্রিকেটে ৫০০-প্লাস রানের (৫৭৬) পার্টনারশিপ তৈরি হয়। ওয়ান-ডে ক্রিকেটকে নতুন অভিমুখে ঠেলে-দেওয়া অলরাউন্ডার সনথ জয়সূর্যের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২১,০৩২ রান, ৪২ টি সেঞ্চুরি, ৪৪০ উইকেট, ২০৫ টি ক্যাচ রয়েছে। আর রয়েছে ২,৪৮৬ টি বাউন্ডারি এবং ৩৫২ টি ছক্কার ছররা।
৫৬ বার আন্তর্জাতিক ম্যাচে ‘সেরা’ হওয়া সনথ জয়সূর্যের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এটা মনে রাখা দরকার, তখনও কিন্তু আইপিএলে অভ্যস্ত হয়নি আমাদের চোখ। তাই আজকে যাদের মারকুটে বলে বন্দনা করছি, তাঁরা এক অর্থে জয়সূর্য-গ্রেটব্যাচদেরই উত্তরসুরী। নতুন সূর্যের ভোর এনেছিলেন ওঁরাই।