ট্রিকস এবং টিপস @ সত্তর দশক

সত্তর দশক মানেই মুক্তির দশক ছিল ক্রিকেটেও।পরপর ২টো বিদেশের মাঠে হওয়া সিরিজ জেতা ছাড়াও আমার মতে ভারতের সর্বকালের সেরা শিল্পী ব্যাটসম্যান, সর্বকালের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান, সর্বকালের সেরা মিডিয়াম পেস বোলার, সবার মূল বিচরণ মৃগয়া ছিল সত্তর দশক।

তা সেই দশকে কেমন ছিল “অফ দ্য ফিল্ড” পরিকল্পনা, যার অঙ্গ ছিল ট্রিকস এবং টিপস? একটি করে উদাহরণসহ সেইদিকে একটু চোখ মেলে দেখা যাক এই লেখায়। সত্তর দশকের একদম গোড়ার দিকের ঘটনাবহুল এই লেখা পড়ার সময়ে মনের ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যানভাসে এই ছবিটা এঁকে ফেলা জরুরী যে তখনো বিশ্বক্রিকেটে মোটের উপর ভারতের স্ট্যাটাস ছিল শুধুই “অলসো প্লেড”। এবং আজকের মত এত স্ট্র্যাটেজিস্ট ও আধুনিক পেশাদার “সৈন্যবাহিনী” তখন সাজঘরের ত্রিসীমানায় দেখতে পাওয়াটা ছিল কষ্টকল্পনা।

দীপ প্রকাশনের “গাভাসকারের জন্ম” বইটির কাছে কৃতজ্ঞতা, এই লেখা তৈরী করে সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারার জন্য।

১) ট্রিকস

১৯৭১-এর ভারতীয় ক্রিকেট টিম। যারা পরপর ২টো বিদেশ সিরিজ জিতে হইচই ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। যে টিমকে বলা হয়, ভারতীয় ক্রিকেটে নবজাগরণের দ্যোতক। সত্যের খাতিরে বলা উচিৎ যে সেই টিমে কিন্তু সুস্পষ্ট দুটি গ্রুপ ছিল।

একটি গ্রুপে অপসারিত অধিনায়ক পাতৌদির অনুগামীরা, যদিও অধিনায়কত্ব হারানো প্যাট সেই সফর দুটি থেকে সরে থাকার অভিলাষে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই দুটি সফরের টিমেই ছিলেন না। মূলত দক্ষিণের আর উত্তরের খেলোয়াড়রা ছিলেন এই গ্রুপে, এক দু জন ছাড়া। অন্য গ্রুপের (মূলত পশ্চিমের খেলোয়াড়রা প্রায় সবাই, এক দু জন ছাড়া) খেলোয়াড়রা ছিলেন সদ্যনিযুক্ত অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকারের অনুগামী।

তা ভারতীয় ক্রিকেট টিম প্রথমে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। অনুশীলন ছাড়াও নিয়মানুবর্তিতা আর টিম মিটিংয়ে খুব জোর দিলেন নতুন ক্যাপ্টেন। কিন্তু ওই যে “আমি গ্রুপে তোমায় ভোলাব না, গ্রুপে তোমায় ঝোলাবো”! কিছু সিনিয়র রোজ অনেক দেরী করে টিম মিটিংয়ে আসাটাকেই নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে ফেললেন। রোজ রোজ টিম মিটিং হতে থাকল অনেক দেরীতে। ওয়াদেকার রুষ্ট হতে হতে ক্রমশঃ অস্থির হয়ে উঠলেন। এবং একদিন উপায় বের করে ফেললেন।

পরদিন তিনি নিজের ঘরে টিম মিটিংয়ের অনেক আগে আসতে বললেন দুই জুনিয়রকে। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে টিম মিটিংয়ের সময় হয়ে গেল। আর কেউ এলেন না দেখে টিম মিটিংয়ের সময় হয়ে যাবার দশ মিনিট পরে দুই জুনিয়রকে বললেন সিনিয়রদের ডেকে আনতে। তাঁরা তাদের নিয়ে টিম মিটিংয়ের জন্য অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকারের ঘরে ঢুকতেই তিনি জুনিয়র দুজনকে তিরস্কার করে উঁচুস্বরে বললেন “টিম মিটিংয়ে সময়ে আসতে হয়, তোমাদের জানা নেই? আর কোনদিন যেন টিম মিটিংয়ে আসতে লেট না হয়।”

সেই দুই জুনিয়র তো অবাক এবং হতচকিত হয়ে গেলেন। তারা তো অনেক আগেই এসেছিলেন! তবু তাদের এভাবে “ঝাড় খেতে” হল। একে জুনিয়র, তার উপর টিম মিটিং শুরু হয়ে যাওয়ার জন্য কেউ কিছু বললেন না তখন।টিম মিটিং শেষে সব সিনিয়র চলে যাওয়ার পরে তাদের কাঁধে হাত রেখে অজিত ওয়াদেকার বললেন, “আসলে তোমাদের কিছু বলিনি, তোমাদের মাধ্যমে ওই সিনিয়রদের বলা হয়েছে কথাগুলো। কাল থেকে এর ফল দেখো।”

ওই দুই জুনিয়র একনাথ সোলকার আর সুনীল গাভাসকার পরের দিন থেকে অবাক হয়ে দেখেছিলেন, আর কেউ কোনদিন টিম মিটিংয়ে দেরী করে আসছেন না। অজিত ওয়াদেকারের এই ম্যান ম্যানেজমেন্টের অনেকটাই শেখা ছিল তার স্টেট ব্যাঙ্ক কালচার থেকে, যেটা তিনি নিজেই পরে বলেছিলেন।

২) টিপস

ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে শিখে টিখে নেবার জন্য (understudy to Farokh Engineer) ১৯৭১ আর ১৯৭৪-এর ভারতের প্রাথমিক টিমে জায়গা পেয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা হুসেন কিরমানি। ১৯৭৫-এর বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডে “ওই একই ক্যাপাসিটি”-তেই টিমে ছিলেন কিরি। তিনটি ট্যুরেই তাঁদের রুমমেট করে দেওয়া হয়েছিল এজন্য।

১৯৭১-এর ৫ বছর পরে ১৯৭৬-এর নিউজিল্যান্ড সফরে টেস্ট আর ওডিআই-তে ভারতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল কর্ণাটকী উইকেটরক্ষক সৈয়দ কিরমানির। ১৯৭৬-এর নিউজিল্যান্ড সফরের আগে কিরিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল “ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে কেমন শিখলেন?”

প্রথমে চারিদিকে একটু তাকিয়ে কিরি নিশ্চিত হয়ে নেন যে আশেপাশে ফারুক নেই। তারপরে সুরসিক কিরি খুব ক্যাজুয়ালি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন “আমি শেখার সুযোগ খুব কমই পেয়েছিলাম। কারণ তিনটে ট্যুরেই অধিকাংশ রাতেই ফারুক হোটেলেই ফিরত না। আর সেটা মোটেই শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিলনা।”