ছক্কাবৃষ্টির ছাটে

গত পরশু দিন পুনের ভ্যাপসা গরমের মধ্যে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্যাট কামিন্সের ম্যাচ-জেতানো ‘ছক্কাবৃষ্টি’-র ধারাস্নানে শরীর জুড়িয়েছেন প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকরা। আহা, অনেকদিন পরে এমন একটা দুর্দান্ত মারকাটারি ইনিংস দেখা গেল! এই ম্যাচটা দেখতে দেখতেই মনে পড়ে যাছিল গ্রানাডায় অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই চতুর্থ একদিনের ম্যাচটার কথা।   

ওয়ান-ডে ক্রিকেট তো নয়, যেন কালীপুজোয় রংমশালের প্রদর্শনী। শুরু থেকেই গ্যালারির অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। কারণ মাঠের ভিতর থেকে একের পর এক উড়ে আসছিল সাড়ে পাঁচ আউন্সের সাদা গোলা। ইংরেজ ব্যাটাররা তখন নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছিলেন ক্যারিবিয়ান বোলারদের। মোট ২৪টি ছক্কার বিশ্বরেকর্ড গড়ে ইংল্যান্ড ইনিংস থামে ৪১৮/৬। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সবচেয়ে বড় রানের ইনিংস গড়ার পিছনে ছিল জস বাটলার (১৫০ রান, ১২টি ছক্কা) এবং অধিনায়ক অইন মর্গ্যানের (১০৩ রান, ৬টি ছক্কা) সেঞ্চুরি। বিশাল টার্গেট তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অবশ্য ভড়কে যায়নি। কারণ নিজেকে যিনি ‘ইউনিভার্স বস’ বলে চিহ্নিত করেছেন, সেই ক্রিস গেইল ছিলেন ওপেনিংয়ে। ৩৬ বলে ১২ রান করে উইকেটে থিতু হতে একটু সময় নিলেও পরের দিকে হয়ে ওঠেন প্রচন্ড মারমুখী। স্থানীয় দর্শকদের উল্লাসের মধ্যে একাই ১৪টি ছক্কাসহ গেইল হাঁকান ১৬২ (৯৭ বল, ১১টি বাউন্ডারি), যার মধ্যে অন্তত বার পাঁচেক বল উড়িয়ে দেন একেবারে স্টেডিয়ামের বাইরে। এই ইনিংসেই সবধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসাবে ৫০০-তম ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর নজির গড়েন গেইল (দ্বিতীয় পাকিস্তানের সৈয়দ আফ্রিদি ৪৭৬টি ছক্কা)। সেইসঙ্গে ছুঁয়ে ফেলেন নিজের ২৫-তম ওডিআই সেঞ্চুরির মাইলস্টোন, টপকান একদিনের ক্রিকেটে ১০,০০০ রানের গণ্ডিও। শেষপর্যন্ত ৪১৮ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করে দেশের মাটিতে সর্বাধিক ৩৮৯ স্কোর করেও ২৯ রানে ম্যাচ হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে ছক্কার ফুলঝুরিতে মেজাজ ফুরফুরে ছিল দর্শকদের। দু’দলের ক্রিকেটাররা এই ম্যাচে মারেন মোট ৪৬টি ওভার বাউন্ডারি, যা একদিনের ক্রিকেটে নতুন বিশ্বরেকর্ড। তার আগে এক ওডিআই-তে সর্বোচ্চ ৩৮টি ছক্কার রেকর্ড ছিল ২০১৩ বেঙ্গালুরুতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে। এক ম্যাচে মোট ৮০৭ রানও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সর্বোচ্চ (বিশ্ব ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বাধিক)।

৩৯ বছর বয়সী ক্রিস গেইলকে এই অতিমানবিক ইনিংসের পরে প্রশ্ন করা হয় “শটে এত জোর পান কী করে ?”

‘আমি তো এমনি-এমনি খাই’— হেলথ ড্রিঙ্কের সেই বিজ্ঞাপনের মতো সহজ নিরুত্তাপ গলায় গেইলের জবাব ছিল– “আমি নেটে একটু-আধটু বিগ-হিটিং প্র্যাকটিস করি।” বেশি দরকার হয়নি, ওই একটু-আধটুতেই চোখে ধুতরো ফুল দেখেছেন বিশ্বের তাবড় বোলাররা। তবে গেইলের এক ইনিংসে ১৬টি ছক্কার রেকর্ড ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ম্যাঞ্চেস্টারে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ভাঙেন ইংল্যান্ডের অইন মর্গ্যান (১৭টি)। 

এই লেখার শেষে আরও কয়েকজন ‘ছক্কারাজ’-এর কথা বলতেই হবে। পাকিস্তানের সৈয়দ আফ্রিদিকে ভোলা যাবে কী করে? ৩৬৯ ইনিংসে ৩৫১ টি ছক্কা হাঁকিয়ে একদিনের ক্রিকেটে এক নম্বরে যে আজও তিনিই। ২০১৯ সালে দেরাদুনে অনুষ্ঠিত আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ড টি-২০ ম্যাচে ওভার বাউন্ডারির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আফগান ওপেনার ২১ বছরের হজরতুল্লাহ জাজাই মাত্র ৬২ বলে করেন ১৬২ রান, যার মধ্যে ছিল রেকর্ড সংখ্যক ১৬টি ছক্কা (আগের নজির অ্যারন ফিঞ্চের ১৪টি)। টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে ১২টি ওভার বাউন্ডারি মারার বিশ্বরেকর্ড আজও ধরা রয়েছে পাকিস্তানের ওয়াসিম আক্রমের ব্যাটের বিক্রমে (বনাম জিম্বাবোয়ে, ১৯৯৬)।

মনে হতে পারে, আজ কেন এই লেখাটা ? কারণ হল আজকের তারিখেই (৮ এপ্রিল, ১৯০২ সাল) প্রকৃত ‘ছক্কারাজ’ আর্থার ওয়েলার্ডের জন্মদিন। ইংল্যান্ড ও সমারসেটের এই দীর্ঘদেহী ফাস্ট-মিডিয়াম পেসার অল-রাউন্ডার ছিলেন ওভার বাউন্ডারি মারায় সিদ্ধহস্ত। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০০-র ওপর ছক্কা হাঁকানো এই হিটার ১৯৩৫ সালে এক মরশুমে ৭২টি ‘ছক্কা’ মারার যে রেকর্ড গড়েছিলেন, ইয়ান বথাম ৮০টি ছক্কা মেরে সেই নজির ভাঙেন দীর্ঘ ৫০ বছর পরে। কেন্টের ফ্র্যাঙ্ক উলি এবং (ডার্বিশায়ারের বাঁ-হাতি স্পিনার) আর্মস্ট্রংয়ের মতো বোলারদের বিরুদ্ধে ওয়েলার্ড একবার নয়, দু-দুবার টানা ৫ বলে ৫টি ছক্কা মারার কীর্তি গড়েন। এ’কালের পেসার-অলরাউন্ডার প্যাট কামিন্সের অবিশ্বাস্য কর্মকান্ডই হয়ে থাকুক সেকালের পেসার-অলরাউন্ডার আর্থার ওয়েলার্ডের জন্মদিনের সেরা ‘উপহার’।