“টনিস্যার”-এর চলে যাবার দিনে

ম্যালকম মার্শালের একজন “টনিস্যার” ছিলেন। ধারা এবং বিবরণী দু’টোকেই দরিদ্র করে দিয়ে তিনি অন্য প্রেস-বক্সে চলে গিয়েছিলেন ২০১৬-র ১১ মে তারিখে। আর আজ আবার সেই ১১ মে, শুধু ৬ বছর বয়ে গেছে মাঝখানে।

একটা কল্পদৃশ্য দেখে ফেলেছিলাম ২০১৬-র ১১ মে তারিখে টনিস্যারের প্রয়াণ রাতের গহীন অন্ধকারের মধ্যে। যে দৃশ্যে ম্যালকম মার্শাল অস্ফুটে বলছিলেন রমন লাম্বাকে – “টনিস্যার” এসে গেলেন। টেকনিক্যাল ফল্টগুলো এবার ঢেকে খেলো বস্।” খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন অঙ্কিত কেশরী আর ফিল হিউজেস। যা শুনে প্রবল অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন মনসুর আলি খান, দিলীপ সরদেশাই এবং আর এক টনি। টনি গ্রেগ। শুধু এম এল জয়সীমাই উদাসীন চোখে শ্রদ্ধা দেখছিলেন ম্যালকম মার্শালের “অ্যাকসেন্ট”-এ। গভীর রাতের দিকে লেগে আসা চোখ দুটো খুলে গেলে আজও সাইটস্ক্রীন সরিয়ে এপারের বাস্তবে ফেরা যায়। আর সেই বাস্তব আজ জানিয়ে দিচ্ছে যে আজ তো আর একটা ১১ মে। ৬ বছর আগে যে তারিখটা কেড়ে নিয়েছিল মার্শালের টনিস্যারকে ।

১৯৬৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম সফরকারী অসট্রেলিয়ার টেস্টম্যাচ সিরিজের ধারাবিবরণীর মাধ্যমে রেডিও ধারাভাষ্যকার হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল ম্যালকম মার্শালের “টনিস্যার” অর্থাৎ  টনি কোজিয়ারের, যার পুরো নাম ছিল উইনস্টন অ্যান্টনি লয়েড কোজিয়ার। ১৯৪০ সালে ব্রাইটনে জন্মানো টনি কোজিয়ার মাত্র ২৬ বছর বয়সেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম বিবিসি’র টেস্ট ম্যাচ স্পেশ্যাল ধারাভাষ্যকার দলের সদস্য হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পেয়ে যান। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন ও স্কাই স্পোর্টস টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারও ছিলেন তিনি। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর হয়েও ধারাভাষ্য দিয়েছেন তিনি। ধারাভাষ্যকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একটি ছাড়া প্রত্যেক উইজডেন ট্রফি সিরিজে তাঁর উপস্থিতি ছিল স্বতঃসিদ্ধ। শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৪-১৫-তে ইংল্যান্ড দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ধারাভাষ্য দেন টনি কোজিয়ার। কেরি প্যাকারের ব্যক্তিগত অনুরোধে বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে তিনি অন্যতম ধারাভাষ্যকার মনোনীত হন। টনি কোজিয়ারের মতে, সাধারণ দর্শক ঐ সিরিজটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। সিরিজের ধারাভাষ্য চলাকালে এক পর্যায়ে “Blue Moon” গানটিও পরিবেশন করেছিলেন তিনি।

তার বাবা জিমি কোজিয়ারও ছিলেন একজন নামী সাংবাদিক। জিমি কোজিয়ারের ছেলেরও ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক ছিল সাংবাদিক হওয়ার দিকেই। কানাডার অটোয়ার কার্লেটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঠের খেলাধুলোর সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। বার্বাডোজের হকি দলের গোলরক্ষক ছিলেন টনি। বার্বাডোজের দুই ক্লাব – ওয়ান্ডারার্স ও কার্লটনের ওপেনিং ব্যাটসম্যানের ভূমিকায়ও দেখা গেছে তাঁকে।

টনি কোজিয়ার যে কত বড় কিংবদন্তি সাংবাদিক-ভাষ্যকার ছিলেন এটা বোঝাতে শুধু এই দু’টো তথ্যই যথেষ্ট:-

১) ২০১১ সালে তিনি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সম্মানজনক আজীবন সদস্যপদ পান।

২) ক্রিকেটে অসামান্য ভূমিকা রাখায় এমনকি কেনসিংটন ওভালের প্রেস বক্সের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়।

বিশ্বের অনেক প্রথিতযশা ক্রিকেটারও এই সম্মান পান নি। টেলিভিশন অনুষ্ঠান “টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল”-এর নির্মাতা পিটার ব্যাক্সটার একবার মজা করে বলেছিলেন যে, প্রকৃতপক্ষে  কেনসিংটন ওভাল প্রেস বক্সের নামকরণ আরেকজন কোজিয়ারের (পড়ুন জিমি কোজিয়ার) নামে হয়েছিল। কেননা কোজিয়াররা পিতা-পুত্র উভয়েই সাংবাদিক ছিলেন।

১৯৭৮ সালে গারফিল্ড সোবার্সের সঙ্গে যুগ্মভাবে বিশ্লেষণধর্মী “দি ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ফিফটি ইয়ার্স অব টেস্ট ক্রিকেট” শীর্ষক গ্রন্থ লেখেন টনি কোজিয়ার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বার্ষিকীর ২২টি সংস্করণের প্রত্যেকটিরই সম্পাদক ছিলেন তিনি, টনি কোজিয়ার। তিনি বিশ্বকাপে উইজডেনের ইতিহাস সম্পাদনা করেন। কলাইভ লয়েড ও মাইকেল হোল্ডিং-এর আত্মজীবনীতেও তার অপার ও অবিসংবাদী ভূমিকা ছিল।

এই “টনিস্যার”-ই তো শুনিয়েছিলেন আর শিখিয়েছিলেন রেডিওর (সেই ১৯৭৪-এ টিভি ছিল অনেক দূরের গ্রহ) মাধ্যমে – “Commerce may win, but romance will never lose.”


সেদিনের হাফ প্যান্ট পরা আপামর কৈশোর আজও রেডিওতে কান পাতলে শুনতে পায় সেই অব্যর্থ ব্যারিটোন – “It’s Tony Cozier from Port of Spain, Trinidad …”

ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভাঙ্গা ৫০১ (৬ জুন ১৯৯৪ তারিখে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে, ডারহামের বিরুদ্ধে) আর ৩৭৫ (১৮ এপ্রিল ১৯৯৪ তারিখে অ্যান্টিগুয়া টেস্টে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে) নিয়ে টনি কোজিয়ার লিখেছিলেন –”There was no real surprise among his countrymen, simply the feeling that his inevitable date with destiny had arrived rather more suddenly than expected.”

আর ১৯৯৯ সালে কুইন্স পার্ক ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ৫১ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে তাঁর ধারাভিষ্যকালীন মন্তব্যে বলা এই লাইনটি তো আজও বিখ্যাত হয়ে আছে – “Where does West Indies cricket go from ’ere?”

কেসরি-কমলা পানপরাগের কুড়ি-বিশে বিকিয়ে যাবার আগের সেই অলৌকিক টেস্টক্রিকেট দিনকালগুলো আর একটু কম রঙ্গীন হত টনিস্যার না থাকলে। এবং ওডিআই ম্যাচগুলোও অবলীলায় ধনী হয়ে যেত টনিস্যার কমেন্ট্রিতে থাকলে।

মনে মনে তার রেডিও কমেন্ট্রি (এবং টেলিভিশন বিশ্লেষণ) শুনেই বাকি জীবনটা দিব্যিই কাটিয়ে দিতে পারেন যে কোন ক্রিকেট অনুরাগী। তারপর একদিন না হয় আচমকা সামনাসামনিই আবার তাদের দেখা হয়ে যাবে টনি কোজিয়ারের সঙ্গে, সাথে থাকবে সেই আশ্চর্যসুন্দর ক্রিকেট ধারাবিবরণীর শ্রুতিমধুর দিনকাল।

ক্রিকেট আর তাঁর ধারাবিবরণীর দিব্যি, ততদিন নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন টনিস্যার।