এখানে ক্রিকেট খেলাও হয়!

সে এক সময় ছিল! মল-সংস্কৃতি তখনও জাপটে ধরেনি বাঙালিকে। সিনেমা মানে নুন-ম্যাটিনি-ইভনিং-নাইট শো। ধর্মতলায় ‘নুন শো’ মানে একটু টক-ঝাল-নুন মেশানো। নাইট শো-য় যাওয়া আর বাড়িতে-পাড়ায় খারাপ শ্রেণীভুক্ত হয়ে-পড়া। বেশিদিন আগে নয়, বছর পনের আগেও ছিল এমন।

ধর্মতলায় নাইট শো একটু এগিয়ে রাত নটার জায়গায় আটটা হয়েছিল। তারপর তো, সেই যেমন বলা হয়, এল কোভিড, নিয়ে গেল সব! আস্তে আস্তে কোভিড-ভীতি কাটিয়ে উঠছেন মানুষ। তবু, নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউস, গ্লোব এখনকার বাবা-প্রজন্মের স্মৃতির পাতায় শুধু। লাইট হাউস আর গ্লোবও, শুনেছি উঠেই গিয়েছে। সর্বত্র শপিং-মল। ছেলে-মেয়েরা লিন্ডসে স্ট্রিট চত্বরে নেই আর। বাবুঘাটের ‘আধো আলো ছায়াতে, কিছু ভালবাসাতে’-ও উৎসাহ কম। উৎসাহ ছিল বরং, বছর দুই আগেও, বাবুঘাট যাওয়ার রাস্তায় ঝকঝকে আলোর ইডেনে। এখন যদিও কোভিডের ছায়ায় অন্ধকার সে মায়াবী মাঠ।

নিয়ন আলোর ঝলকানিতে ছিল নিজস্বী-নির্ভর ফেসবুক-আপডেট ভরপুর চার-ছয় যাপন ঘণ্টা চার। হিরো আছে, নাচ, স্বল্পবসনা চিয়ার লিডার। পয়েন্ট, কভার, স্লিপ, গালির কূটকচালি ছাড়ুন! ‘তুনে মারি এন্ট্রি ইয়ার, দিলমে বাজি ঘণ্টি ইয়ার’, ‘ও সোনা, ও সোনা, ও সোনা…’!

ইডেনে না-থাকলেও বলিউডের মক্কায় আইপিএল নামক এই নাইট শো-য় ক্রিকেট আছে, অনেকগুলো অত্যাবশ্যক উপাদানের একটি হয়ে। ‘এখানে ক্রিকেট খেলাও হয়’ ট্যাগলাইন সহযোগে, ঠিক যেমন টাটা স্টিল-এর ঐতিহাসিক বিজ্ঞাপন ছিল ‘উই অলসো মেক স্টিল’। স্কোরাররা প্রায় ওয়েব সাইটের মতো বলে-বলে বলতে থাকেন কটা চার, কতগুলো ছয়। উৎসাহ যে কেবলই সেখানে। অধুনা জুড়েছে দূরত্বের মিটার। ৬৭, ৭৪, ৮৮, ৯৫, কেউ কেউ পারলে সেঞ্চুরি হাঁকাচ্ছেন মিটারে! আসলে বল পাঠাচ্ছেন ব্যাটাঘাতে, ঠিক অতটাই দূরে। সেই দূরত্বের মাপ চোখের পলকে নিখুঁত যন্ত্রে। আরও দূরে, আরও জোরে বল পাঠানোর অবিরাম লড়াই। সার্কেলের বাইরে কজন, কজনই বা ভেতরে, কী যায় আসে!

আইপিএল আরও স্মার্ট করেছে একসময়ের অলস বয়ে-চলা ক্রিকেটকে। পঞ্চাশ ওভারের চেয়েও অনেক বেশি স্মার্ট, স্মার্টতর। ক্রিকেট মানে কে কত নম্বরে ব্যাট করতে নামবে, কে কখন বল করতে আসবে নিয়ে অফুরান আলোচনা। কেন অমুককে তিনে নামানো হল, কেন সাত থেকে তুলে আনা চারে – ছ’ঘণ্টার ক্রিকেট খেলার আগে-পরে এমন আলোচনা চলে ঘন্টা চারেক। এই কুড়ি ওভার এসে এমন রোমান্টিক ভাবনাবিলাসের গোড়া ধরে টান মেরেছে এমন জোরে, সমূলে উৎপাটন প্রায়! নতুন বল, বলের পালিশ, জোরে বোলার, তিনটে স্লিপ-গালি, কোথায় কী? এক দীপক প্যাটেল অমরত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো-কে, এখন আইপিএল-এর বাজারে স্পিনাররা ইনিংস শুরু করছেন রোজ, বল হাতে। 

অভাবিত শব্দটাই হারিয়ে গিয়েছে, স্টেডিয়ামের বাইরে চলে-যাওয়া বলের মতো। খুঁজে পাওয়া যায় না নয়, খোঁজার ইচ্ছেও নেই কারও। পরের বলটা করতে তৈরি বোলার, আরও একটা ঘষামাজা বল এসে গিয়েছে হাতে। ব্যাটারও তৈরি ব্যাট উঁচিয়ে। অংশুমান গায়কোয়াড়ের ব্যাট এত উঁচুতে থাকত যে, নামতে সময় বেশি নিত, ম্যালকম মার্শালের মতো বোলারদের বলের গতি সেই ব্যাট নামার আগেই পা বা স্টাম্প নড়িয়ে দিত। হাই ব্যাকলিফট তাই গায়কোয়াড়দের জমানায় অচ্ছুতগোত্রের ছিল। আইপিএল-এ ব্যাটাররা শুরুই করেন ব্যাট ওপরে রেখে। মাটি থেকে ওপরে তুলে আবার নামানোর মধ্যে সেকেন্ডের কিছু ভগ্নাংশের যে-সমস্যা, আর নেই তাই। সরাসরি ওপর থেকে নীচে নামছে, সময় নষ্ট হচ্ছেই না। সময় যে আসলে কারও নেই আইপিএল-এ!

বোলারের হাতে চারটে ওভার, ব্যাটারের হাতে গদা, মোট ১২০ বলের খেলা, বাকি ক্রিকেটাররাও মাঠের ধারে, ‘ডাগ-আউট’ নাম। এই এক্ষুনি-এক্ষুনি খেলায় এক্ষুনি লেখার দায় বেড়েছে ক্রিকেট-লিখিয়েরও। দুপুরের ভোজন, চাপানের বিরতিসহ ঘণ্টা আটেকের ক্রিকেট দেখার পর এলিয়ে ম্যাচ-রিপোর্ট লেখার সুযোগও নেই। অধিকাংশ ম্যাচ শেষ হয় যখন, ডেডলাইন পেরিয়ে যায়। কাগজের সংখ্যা বেঁধে রাখতে হয়, দ্বিতীয় সংস্করণে ম্যাচ রিপোর্ট দিয়ে বেশি ছাপতে চেয়ে। গতি মুখ্য এখানেও। তাই ক্রিকেট-লেখায় সে অলস-রোমান্টিসিজমও ছুটিতে, আগামী মাস দুই অন্তত।

সুতরাং, সন্ধেবেলা টিভি খুলুন, ছয়-চারে মেতে উঠুন, মোহিত থাকুন আগামী মে পর্যন্ত। রাজ কাপুর কত বড় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন, চাইলে আর একবার ভেবেও নিতে পারেন। সেই কবে পর্দায় তাঁর জোকার-সত্ত্বা মান্না দে-র কণ্ঠে গাইয়েছিল, ‘শো হ্যায় তিন ঘণ্টে কী’!

ছবি : আইপিএল