এই লেখাটা লিখতে বসলাম যখন তখন অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে, পটকা ফাটার আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝে-সাঝে, শুরু হয়েছিল পাক্কা আড়াই ঘন্টা আগে, ঠিক যখন রবীচন্দ্রন অশ্বিন মিড অফের ওপর দিয়ে বাঁ-হাতি স্পিনার মহম্মদ নওয়াজের বলটিকে চিপ করে দিয়ে এক অবিশ্বাস্য টি২০ ম্যাচে যবনিকা ফেলে দিলেন।
হ্যাঁ, এ জীবনে বহু-বহু ক্রিকেট খেলা দেখার পরও ভারত-পাকিস্তানের বিশ্ব টি২০র এই দ্বৈরথ আমার দেখা সেরা খেলাগুলির তালিকায় একদম ওপর দিকে থাকবে। (ইডেনে বসে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার ২০০১এর সেই অমর টেস্ট এখনও প্রথম স্থান অধিগ্রহণ করে বসে আছে যদিও।)
কী ছিল না খেলাটিতে। দু দলের অসাধারণ পেস বোলিং, স্পোর্টিং পিচ, মহানাটকীয় কামব্যাক, অসাধারণ পার্টনারশিপ বিতর্ক, শেষ বল অব্দি টেনশন, এবং একটি মাহকাব্যিক ইনিংস।
স্কোরবোর্ড বলবে ভারত পাকিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে। কিন্তু সে বলা আর কী বলা এরকম একটি খেলার পর?
অন্ধকার নেমে এসেছে বললাম বটে, কিন্তু বিরাট কোহলির আজকের অমর ইনিংস ভুত চতুর্দশীর এই রাতটি আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছিল বাইরে আলো থাকতে থাকতেই। ওই ক্লিশে অনুযায়ী আগাম দীপাবলি নিয়ে এসেছিল ভারতের ঘরে-ঘরে।
বহু বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভাবতে শুরু করেছিলেন বিরাটের হয়ত ভারতের টি২০ দলে আর জায়গা নেই।
তাঁরা আজ কী ভাবছেন কে জানে? ৫৩ বলে ৮২ রানে অপরাজিত থাকা বিরাট সত্যিই যে ক্রিকেট জীবনে অপরাজিত আছেন এখনও সেটাই মেলবোর্নে প্রমাণ করে দিলেন তাঁর উইলোর মাধ্যমে। তিনি ফুরিয়ে জাননি, বরং নতুন প্রত্যয়ে তাঁর জিনিয়াসকে মেলে ধরছেন ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য পিওর ব্যাটার হিসেবে, এটাই জানান দিলেন।
১৬০ তাড়া করতে নেমে যখন ভারতের প্রথম ৪টি উইকেট অল্প রানে পড়ে যায় এবং প্রয়োজনীয় রান রেটের অনেক পেছনে থেকে বিরাট ও হার্দিক ইনিংসের হাল ধরেন, তখন মনে হচ্ছিল দুই মহারথী খেলাটিকে এমএসডি সুলভ অ্যাপ্রোচে ডিপ নিয়ে যাবেন, কিন্তু তাও কাজটি বড্ড বেশি কঠিন মনে হচ্ছিল সে সময়ে। ম্যাঞ্চেস্টারে ২০১৯এর ৫০ ওভার বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এবারও কি প্রথম দিকের ব্যাটিং ধ্বস মিডল ওভারের লড়াই কে বিফল প্রতিপন্ন করবে? ১০ ওভার পর সত্যিই টার্গেটটা অনেক আলোকবর্ষ দূর মনে হচ্ছিল। বিশেষ করে যখন ব্যাটার বলতে কেবল দীনেশ কার্তিক বাকি রয়েছেন, অশ্বিন ঠেকনো দিতে পারেন, কিন্তু একা আগ্রাসী হয়ে এই রান তুলতে পারবেন বলে মনে হচ্ছিল না।
পাল্টা মারটা সেই নওয়াজের বলেই শুরু করেন হার্দিক। বিরাটও এতক্ষণ ইনিংস্ অ্যাঙ্কর করার পর যেন খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
তবে এরপর পাকিস্তান যখন তাঁদের ক্ষুরধার পেসারদের ফিরিয়ে আনেন তখন হার্দিক আটকা পড়ে যান। একা আগ্রাসী তখন সেই বিরাট, ক্লাসিক্যাল, ব্যাটিং ব্যাকরণের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের অন্যতম বিরাট।
শাহীন আফ্রিদি হোক কি হারিস রাউফ, বিরাট তাঁর তুণীরের সমস্ত তীর আজ প্রয়োগ করে শুধু পাকিস্তানের সেরা পেসারদের প্রতিহত করলেন তাই নয়, রানও করে গেলেন।
কখনো আফ্রিদিকে ইন্সাইড-আউট লফটেড কভার ড্রাইভে চার মারলেন, কখনো রাউফের গুড লেংথ বল কে অবিশ্বাস্য স্ট্রেট ড্রাইভে লং অনের ওপর দিয়ে স্ট্যান্ডে পাঠালেন।
এত কিছুর পরও শেষ ওভারে ১৬ রান বাকি ছিল। এবং নওয়াজের প্রথম বলেই হার্দিক আউট হয়ে গিয়ে বিপদ বাড়ল। কিন্তু সেই বিরাটই একটি ফুল টস থেকে ছয় মারলেন। এবং তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে লেগ আম্পায়ার মারে ইর্যাস্মাস বলটাকে নো বল ঘোষণা করলেন। তাঁর মতে বলটি ওয়েস্ট হাই ছিল। বিতর্ক হল, কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টালো না, ভারত জয়ের সরণিতে চলে এল।
বিরাটের সেরার-সেরা ইনিংস জয় আনল।
বিরাট ক্রিকেট জীবনের মধ্যগগনেই কিংবদন্তি হয়ে গেছিলেন এবং তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল বলেই মনে হয়। এমনিতেই তাঁর আগ্রাসী ইমেজ, অ্যারোগেন্স এর অভিযোগ, ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেওয়া, চলে যাওয়া, সেই নিয়ে বিতর্ক, ফর্ম চলে যাওয়া, ৭১তম সেঞ্চুরির প্রতীক্ষা, ইত্যাদি তাঁকে আশ্চর্য রুপে একটি কোণায় ঠেলে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, সেই বিরাটকে যিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সর্বময় কর্তাই ছিলেন আখেরে কিছুদিন আগে অব্দি, যাঁর ব্যাটিং প্রতিভা ও অধিনায়কত্বের মেজাজই তাঁকে সেই আসনে উপনিত করেছিল।
একনায়কতন্ত্রের অভিযোগও যে ভেসে আসেনি তা নয়, কিন্তু ভারতীয় দল বিরাট-শাস্ত্রী যুগে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল এ কথাও অনস্বীকার্য। শুধু গলায় কাঁটার মত বিঁধেছিল আইসিসি ট্রফি জিততে না পারার গ্লানি। এমন কি টেস্টের আঙিনাতেও, যেখানে বিরাট যুগ ভারতকে সবচেয়ে সাফল্য এনে দেয়, সেখানেও বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জোটে অপ্রত্যাশিত হার।
আগের বারের বিশ্ব টি২০র আগেই যেন মনে হচ্ছিল সব পেলে নষ্ট জীবন বলেই যেন অধিনায়ক বিরাট সফল হলেও কোনদিন মাল্টি নেশন প্রতিযোগিতায় ভারতকে জেতাতে পারবেন না।
আজকে মিরাকেল ইন মেলবোর্নে কিংবদন্তি ব্যাটার বিরাটের ক্রিকেট মহাবিশ্বে প্রত্যাবর্তন যেন সম্পূর্ণ হল।