কী অদ্ভূত মিল! তাই না? ২০১১–র সিনিয়র বিশ্বকাপ ফাইনাল। ওয়াংখেড়েয় আছড়ে পড়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ছয়। বিশ্বজয়ের উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। এগারো বছর পর সেই ছবিই ফিরে এল অ্যান্টিগুয়ায় স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে। লং অনে ছিটকে পড়ল কিপার–ব্যাটার দীনেশ বানার ছয়। ভারতীয় ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে সংযোজিত হল নতুন অধ্যায়। আরও একবার অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ হাতে উঠল ভারতের। এই নিয়ে পাঁচবার। ২০০০, ২০০৮, ২০১২, ২০১৮–র পর ২০২২। যুব বিশ্বকাপে ভারতের চিরকালীন দাপট অব্যাহত।
বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক যশ ধুলকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। এদেশের প্রাক্তন থেকে বর্তমান ক্রিকেটার, সবাই প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ তারকাকে। যশের অধিনায়কত্বে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন বিরাট কোহলি। মাঠে আগ্রাসী মানসিকতা, প্রকৃত নেতার মতোই ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং পরিবর্তন। যশের এই গুণ নজর কেড়েছে বিশ্বকাপের আগাগোড়া। শায়িক, হার্নুর, রাজ, রবি, ভিকি, কৌশল, নিশান্তদের নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে সাফল্যের ফুল ফুটিয়েছে তরুণ ভারত। গোটা বিশ্বকাপে যশ ব্রিগেড অপরাজিত। আক্ষরিক অর্থেই একটা দল হয়ে উঠতে পেরেছিল ভারত।
তবে এই সাফল্য রাতারাতি আসেনি। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির (এনসিএ) বর্তমান প্রধান ভিভিএস লক্ষ্মণ তারিফ করেছেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকার। কারণটা খুব স্পষ্ট। দীর্ঘ কোভিড পর্বে কোনও প্রতিযোগিতায় খেলা তো দূর, প্র্যাকটিস করাই ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। আর এই সময়েই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছিলেন তৎকালীন এনসিএ প্রধান রাহুল দ্রাবিড়। সঙ্গে ছিল তাঁর কোর গ্রুপ। সবাই পাশে পেয়েছেন বোর্ডকে। খেলা বন্ধ থাকলেও ক্রিকেটারদের দিকে কড়া নজর ছিল। ক্রিকেটার তো বটেই, তাঁদের ব্যক্তিগত কোচেদেরও অনলাইনে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্র্যাকটিসের। যিনি যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, ক্রিকেটাররা নিজেদের তৈরি করেছেন সমানতালে। আমেদাবাদে অনূর্ধ্ব ১৯–এর বিশেষ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে ক্রিকেটার বাছাই করা হয়েছে। যেখানে ছিলেন প্রায় ৯০ জন ক্রিকেটার। আশ্চর্যের হল, এই অনূর্ধ্ব ১৯ দল একসঙ্গে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়েছিল এশিয়া কাপের আগে। মাত্র চার দিন!
গোটা দলেই ছড়িয়ে পড়েছিল লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ। ছিল ইস্পাতকঠিন মানসিকতা। ছিল অদম্য জেদ। বিশ্বকাপের মধ্যেই ভারতীয় শিবিরে হানা দিয়েছিল কোভিড। যশ–সহ ছ’জন ক্রিকেটার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমন বিপদেও দিশা হারায়নি ভারতীয় দল। বাকিরা বাড়তি দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্রিকেটারদের সঙ্কল্প ও সাহসের উল্লেখ করে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন বিসিসিআই সভাপতি। সৌরভ গাঙ্গুলির কথায়, ‘ওদের এফর্ট অমূল্য।’
যশরা এবারের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পরই মাইকেল ভন জানিয়েছিলেন নিরাপদ হাতেই আছে ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। খারাপ কিছু বলেননি ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। কিন্তু সতর্কও থাকতে হবে। অতীতে ‘পা হড়কে’ যাওয়ার উদাহরণ কম নেই। ২০১২–য় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন উন্মুক্ত চাঁদ। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই ক্রিকেটার পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোতেই ঢুকতে পারেননি। অনেক সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একসময় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের মঞ্চেই নিজেদের মেলে ধরেছিলেন কমল পাসি, মনজোৎ কালরার মতো তরুণরা। পরে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছেন। এবারও সেই আশঙ্কা আছে। কিন্তু আশার কথা বিসিসিআই এবং এনসিএ ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৯ ও অনূর্ধ্ব ২১–এর মাঝামাঝি একটা দল বানানো যায় কিনা, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বোর্ডের অন্দরে। যাতে বিশ্বকাপজয়ী এই তুর্কিদের আরও পরিচর্যা করা যায়।
আপাতত আশা–আশঙ্কাকে দূরে সরিয়ে বিশ্বজয়ের আনন্দ উপভোগ করুন যশ, রাজ, রবিরা। একজন ক্রিকেট অনুরাগীর পক্ষ থেকে গোটা দলের জন্য রইল অভিনন্দন, ভবিষ্যতের শুভেচ্ছা।