বাংলা কি ফাইনালে ‘চোকার্স’?

বাংলার ক্রিকেট কতটা এগিয়েছে ? না, প্রশ্নটা শুধু ছুঁড়লেই হবে না । কোন মহলে এই নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে গোড়াতেই ভাবা দরকার সেটা । কারণ যদি কোনও ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে-আসা অভিভাবকদের অনেকেই আপনার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ময়দান-চলতি ভাষায় নির্ঘাৎ কিছুক্ষণ ‘মেপে’ নেবেন আপনাকে । তারপর গুটি-গুটি পায়ে আপনার পাশ-ঘেঁষে এসে দাঁড়াবেন । চারদিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক কাউকে কাছাকাছি না দেখতে পেলেই ফিসফিসিয়ে বলে ফেলবেন “কে আর ক্রিকেটের কথা ভাবছে বলুন ?” তার পরে আরও লেপ্টে এসে পেটের ভিতর থেকে ‘দুসরা’-টা ডেলিভারি করে দেবেন “টাকা ছাড়া এখানে কিস্যু হবে না দাদা ।” ছেলেকে নিয়ে তো কম দিন ঘষছি না !”
“বলেন কী ? এখানেও টাকা লাগে ?”

ছবি: গুগল

আপনার বিস্ময় প্রকাশের ধরণটা সত্যি মনে হলে জানার আগ্রহ মেটাতে এ’বার তিনিই স্টেপ-আউট করে বলে ফেলবেন “কোচ তো নয়, এক নম্বরের পয়সা-পিশাচ । আমার ছেলেটাকে সেকেন্ড ডিভিশনে ঢুকিয়ে রেখেছে, নিয়মিত নয়, মাঝেমধ্যে একটা করে ম্যাচ খেলায় আর বাস্তু-ঘুঘু অ্যাসিস্ট্যান্টদের দিয়ে আমার কাছে টাকা চেয়ে পাঠায় ।”

“তাহলে আপনিই বা এখানে ছেলেকে খাঁচার পাখি করে রেখেছেন কেন ? অন্য কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন !”

ভদ্রলোক এমনভাবে তাকালেন যেন পৃথিবী্র নবম আশ্চর্যের কথাটা এইমাত্র আপনার মুখে শুনে ফেললেন ! তার পরে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে-থাকা এক ভদ্রলোককে হাতের আঙুলের সন্তর্পণ ইশারায় অনুচ্চকণ্ঠে ডাকলেন “ঝন্টুদা, একটু এদিকে এসো ।” লাল-কালো হরাইজন্টাল স্ট্রাইপ স্পোর্টস গেঞ্জি পরা ঝন্টুদা এসে এ’বার যে কাহিনি আপনাকে শোনালেন তা হুবহু খানিক আগে শোনা গল্পের রিপিট ব্রডকাস্ট । শুধু তার ভাইপোর কোচিং সেন্টার এবং ক্লাবটি ভিন্ন । কিন্তু অভিযোগ এক । ঝন্টুদা নতুন আরেকটি অভিযোগ জানালেন, লক্ষ্ণৌ, আলিগড় থেকে সব ছেলে নাকি কলকাতায় খেলতে আসছে ঝাঁকেঝাঁকে ।তাদের নাকি আধার কার্ডও তৈরি করে দেওয়া হয় ।তাদের পিছনে খরচা কম । তারা রীতিমতো মেহনত করতে পারে । এরপরই সেই মোক্ষ্ম প্রশ্ন “আচ্ছা বলুন তো, সিএবি কি বাইরের ছেলেদের ক্রিকেট কেরিয়ার গড়ার কারিগর ?”

আপনি যদি ভুল করে বোঝাবার বা বুঝতে চাইবার জন্য বলে ফেলেন “দেখুন, বাইরের লড়াকু ছেলেদের সঙ্গে না খেললে এখানকার ছেলেরা লড়াই করাটা শিখবে কীভাবে ? অরুণলাল, দিলীপ দোশি, দেবাং গান্ধি থেকে শুরু করে হাল আমলের মহম্মদ সামি সবাই তো বাংলার বাইরে থেকে এখানে এসেছেন এবং রাজ্যের হয়ে ক্রিকেট জীবনে হার্ড ফাইট করে গিয়েছেন ।তাঁদের সঙ্গে বঙ্গজ ক্রিকেটারদের খেলতে তো অসুবিধা হয়নি কখনও !”

মুস্কিল হচ্ছে, স্থানীয় কিছু কোচেরও ধারণা, তাদের ক্যাম্পের ছেলেদের প্রতিও অবিচার করছে সিএবি ।কিছু ক্লাবের মাতব্বর কর্তা নাকি আছেন সিএবিতে, তাঁদের অঙ্গুলি-হেলনেই বাংলা দলের ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়ার খেলা চলে । এই সব কোচদের সম্পর্কে প্রয়াত গোপাল বোস একদা চাঁছাছোলা ভাষায় বলেছিলেন “কিছু কোচ আছে যারা শৈশবকে খুন করছে ভুলভাল ক্রিকেট শিখিয়ে । এরা শুধু নাকি কান্নাই কাঁদে ।”

আপনি যত শুনবেন ততই বিভ্রান্ত হবেন ।কেউ প্রমাণ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন না । একটা কথা ঠিক, সিএবি ক্রিকেটার গড়ার চেষ্টায় প্রচুর সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে ।পাশাপাশি এটাও ঠিক, জাতীয় ক্রিকেটে বাংলার আসল সাফল্য আসছে না ।১৯৩৬-৩৭ সালে বাংলা রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম খেলতে নামার তৃতীয় সিজনেই ‘রানার্স’ হয় নবনগরের কাছে হেরে । মাত্র দু বছর পরেই ১৯৩৮-৩৯ সালে টম লংফিল্ডের অধিনায়কত্বে তারা চ্যাম্পিয়ন ।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তার পরে দ্বিতীয়বার ট্রফি ঘরে তুলতে লেগে যায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর (যার মধ্যে রানার্স ৭ বার)! ১৯৮৯-৯০ মরশুমে ইডেনে দিল্লিকে ফাইনালে হারিয়ে রঞ্জি জেতার অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃ্ত্বে । সেবারই ফাইনালে রঞ্জিতে অভিষেক হয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের । সেবার ৮ ইনিংসে ১০৭.৫ গড়ে ৬৪৫ রান করেছিলেন বাংলার বর্তমান কোচ অরুণলাল (ফাইনালেও নট আউট ছিলেন) । কিন্তু তারপরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল । গত ৩১ বছরে বাংলা বার চারেক ফাইনালে উঠলেও হেরে যায় যথাক্রমে মুম্বই(১৯৯৩-৯৪), উত্তর প্রদেশ(২০০৫-০৬), মুম্বই(২০০৬-০৭) এবং সৌরাষ্ট্রের(২০১৯-২০) কাছে ।সিএবির দিক দিয়ে চেষ্টা চালানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে অশোক মালহোত্রা থেকে শুরু করে সৈরাজ বাহুতুলের পরে অরুণলালকে কোচের পদে এনে । কিন্তু আসল কাজটা তো করতে হবে ক্রিকেটারদের । সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শেষবার শেষদিনে ৬৩ রানে নট আউট ছিলেন অনুষ্টুপ মজুমদার । কিন্তু তিনি আউট হওয়ার পরে বাংলা মাত্র ২৭ রানে ৪ উইকেট খুইয়ে প্রথম ইনিংসে ‘লিড’ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগটি হারায় ।এর উত্তর কার কাছে পাওয়া যাবে ?

গতবছর অতিমারির কারণে রঞ্জি ট্রফি বন্ধ ছিল । এবার আবার নতুন শুরু ।বাংলা কি পারবে ট্রফিটা এইবার ঘরে আনতে ?